পাঁচ দশক পর এবার ফের একবার বড়পর্দায় পা রাখল ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’! সত্যজিৎ রায় পরিচালিত এই বিখ্যাত ছবির পুনরুদ্ধার করা ঝকঝকে সংস্করণটি দক্ষিণ কলকাতার অন্যতম জনপ্রিয় প্রেক্ষাগৃহ ‘প্রিয়া’তে ইংরেজি সাবটাইটেল সহ প্রদর্শিত হয়েছে। প্রিয়া’-র কর্ণধার অরিজিৎ দত্ত-র বাবা-মা যৌথভাবে ছিলেন অরণ্যের দিনরাত্রি ছবির প্রযোজক। অন্যদিকে, ৩১তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও এই ছবির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তার পরের এক সপ্তাহ জুড়ে সারা বাংলা সহ গোটা দেশজুড়ে প্রদর্শিত হচ্ছে এই ছবি। অবশ্যই নির্বাচিত সব প্রেক্ষাগৃহে। এবং বহু মানুষ হইহই করে দেখছে এই ছবি। 

বাংলার তো বটেই ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত সত্যজিতের এই কাজ। ছবির মুখ্য চরিত্রে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, শমিত ভঞ্জ, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, সিমি গারেওয়াল এবং শর্মিলা ঠাকুর। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-কে অনেকেই সত্যজিৎ রায়ের সেরা ছবির তালিকায় রাখেন।  দশকে মুক্তি পাওয়ার পর এই ছবি ঘিরে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল জনতামহলে। সমালোচকরাও অকুন্ঠ প্রশংসায় কানায় কানায় ভরিয়ে দিয়েছিল এই ছবির সমালোচনার পাত্র। পাঁচ দশক পেরিয়ে এবার ফের একবার বড়পর্দায় পা রাখল ‘অসীম-শেখর-সঞ্জয় হরি’রা!


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭০ সালে। ছবিটি চার শহুরে যুবকের গল্প যারা কলকাতার কোলাহল থেকে পালিয়ে এক অরণ্যে বেড়াতে যায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, সমিত ভঞ্জ ও রবি ঘোষ ছিলেন সেই চার বন্ধুর ভূমিকায়। তাঁদের জীবনে আসে একাধিক নারী চরিত্র-শর্মিলা ঠাকুর, কবেরী বোস এবং সিমি গারেওয়াল। যারা এই চারজনের জীবনের গোপন দ্বন্দ্ব, আকাঙ্ক্ষা এবং সম্পর্কের সূক্ষ্ম স্রোতকে উন্মোচন করে। ছবির পুনরুদ্ধার করা ঝকঝকে সংস্করণটি প্রেক্ষাগৃহে দেখতে হাজির হয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়-ও! বর্তমানে তিনি খানিক অসুস্থ। তবু হুইল চেয়ারে বসেই তিনি হাজির হয়েছিলেন প্রেক্ষাগৃহে। এত বছর পর প্রেক্ষাগৃহে এই ছবি দেখে কেমন লাগল তাঁর? সুনীল যদি আজ বেঁচে থাকতেন তিনিও কি যেতেন? ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবি নিয়ে চলতি বছরে কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব - দু'জায়গাতে আজও যেমন উন্মাদনা, তা দেখে কেমন অনুভূতি হত সুনীলের?  সবকিছু নিয়েই নিজের মনের কথা আজকাল ডট ইন-এর সঙ্গে ভাগ করে নিলেন সুনীল-পত্নী। 


“শরীরটা আজকাল খুব একটা ভাল নেই। তবু সুনীলের লেখা...সত্যজিৎ বাবুর এই বিখ্যাত ছবি দেখার আমন্ত্রণ যখন এসেছিল, ঠেলতে পারিনি। পুরোটা বসে দেখেছি। অদ্ভুত ভাল লেগেছে। এই ছবি এমনিতে আমার প্রিয় ছবিগুলোর মধ্যে একটি। আসলে, এই ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল আমাদের বিয়ের বছর খানেকের মধ্যেই, তাই ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র প্রতি একটা আলাদা মায়া-ভালবাসা তো আছেই। এই ছবি যখন মুক্তি পেয়েছিল প্রথমবার, সুনীল আর আমি দু’জনে মিলে একসঙ্গে দেখতে গিয়েছিলাম। সুনীলের প্রথমবারে ভাল লাগেনি এই ছবি। আসলে, এই উপন্যাসটা ওর প্রথম দিকের লেখা। হৃদয়ের খুব কাছের ছিল। তবে সিনেমা তো আলাদা একটা মিডিয়াম। ফলে সেখানে এই গল্প বলতে গেলে, একটু তো বদলাবেই...সেটাই দস্তুর। আসলে ওর মনে হয়েছিল যে ও যেরকম মনোভাব নিয়ে উপন্যাসটি লিখেছিল, সত্যজিৎ বাবুর তৈরি এই ছবি থেকে সেই মনোভাবের আঁচ ও পাচ্ছে না।  তবে ওই যে বড়পর্দায় ও বইয়ের মলাটের মধ্যে গল্প বলার ফারাকটা সুনীল তখন বোঝেনি বলেই ঈষৎ রাগ করেছিল।....” বলতে বলতে হেসে ফেললেন স্বাতী। 

 

খানিক থেমে ফের বলা শুরু করলেন তিনি – “পরে অবশ্য বুঝেছিল এবং সেকথা প্রকাশ্যে বলেওছিল। সত্যজিৎ রায়ের মতো মাপের একজন পরিচালক ওর লেখা নিয়ে ছবি করছেন, এই বিষয়টি নিয়ে খুব আনন্দ পেয়েছিল সুনীল। এবং তারপর যখন দেখল নিজেদের ঘরের পাশাপাশি বিদেশেও এই ছবিকে দুরন্তভাবে গ্রহণ করছেন দর্শক, তখন অবাক হয়ে গিয়েছিল। আনন্দ তো পেয়েছিল বটেই। পরে তো সুনীলের লেখা প্রতিদ্বন্দ্বী উপন্যাসটিও ছবি হিসেবে তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ রায়।”


“আমার দৃঢ় বিশ্বাস আজ যদি সুনীল বেঁচে থাকত, খুব আনন্দ পেত। একটু অবাকও হয়তো হত, এই ভেবে যে এখনও বোহেমিয়ান জীবনের ছবি মানুষ ভালবাসে, বোহেমিয়ান হওয়ার ইচ্ছে মানুষের করে। সুনীল ভীষণ জীবনমুখী ছিল, সবাইকে নিয়ে হইহই করে বাঁচতে খুব ভালবাসত। তাই আমি নিশ্চিত, সুনীল যদি আমাদের মধ্যে থাকত তাহলে ও এই ছবি আমাদের সঙ্গে ঠিক দেখতে যেত। হয়ত বলে উঠত, “চলো, দেখেই আসি।” 


সত্যজিৎ-পুত্র তথা জনপ্রিয় পরিচালক সন্দীপ রায় এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন বাবার পরিচালিত ছবির তালিকায় এই ছবিটি তাঁর সবথেকে প্রিয়। কেন? জবাবে সন্দীপ বলেছিলেন, “অনেক তারকার সমাবেশ এই ছবিতে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, সিমি গারেওয়াল, রবি ঘোষ, শমিত ভঞ্জ-সহ সেই সময়ের প্রথম সারির তারকা অভিনেতারা কাজ করেছেন। ছবি জুড়ে বাবার সূক্ষ্ম মনস্তত্বের পরিচয়, যা কখনও উচ্চকিত ভাবে ছবির মূল সুরকে ছাপিয়ে যায়নি।" সন্দীপ তাই ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’কে তাঁর বাবার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য বলে দাবি করেছেন।