শিশুমনের নিভৃতে লুকিয়ে থাকা অনুভূতিগুলোর খোঁজ আমরা বহু সময়েই রাখি না। তাদের ভাললাগা-খারাপলাগা, আনন্দ, কষ্ট, অভিমান কিংবা বন্ধুত্ব, সবই যেন নিঃশব্দে চাপা পড়ে যায় আমাদের দৈনন্দিন ব্যস্ত জীবনের আড়ালে। সাম্প্রতিক সময়ে সেই অদৃশ্য দেয়াল ভেঙে দিয়েছে উইন্ডোজ প্রডাকশন। ‘রামধনু’, ‘হামি’, ‘পোস্ত’, ‘দাবাড়ু’-সহ একাধিক ছবিতে ছোটদের আবেগ, স্বপ্ন ও বাস্তবতার সূক্ষ্ম রূপ অনবদ্যভাবে ফুটে উঠেছে বড় পর্দায়। তুলে ধরেছে ‘সহজ যাপন’-এর আড়ালে লুকিয়ে থাকা তাদের আবেগের আস্ত অভিধান। তাঁদের আসন্ন ছবি ‘ভানুপ্রিয়া ভূতের হোটেল’-এও বজায় আছে সেই ধারা কেন ছোটদের ছবির প্রতি এই ঝোঁক? ১৪ নভেম্বর, শিশু দিবসে খোঁজ করল আজকাল ডট ইন।

পরিচালক নন্দিতা রায়ের কথায়,  “শিশুদের জগৎ আমাদের বরাবরই গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছে। তাদের নিখাদ সততা, বিস্ময়ে ভরা দৃষ্টি, আর স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সত্য বলার ক্ষমতা। সেই টান থেকেই তৈরি হয়েছে ‘রামধনু’, ‘হামি’ এবং ‘হামি ২’, প্রতিটি ছবি নতুন করে খুলে দিয়েছে এক-একটি জানালা, দেখিয়েছে শিশুরা কীভাবে পৃথিবীকে দেখে এবং সেই দৃষ্টিতে আমরাও কীভাবে নিজেদের নতুনভাবে চিনতে শিখি।”

চমকপ্রদ তারকাবহুল কাস্টের ভিড়েও শিশু শিল্পীরা কখনও আড়ালে হারিয়ে যায়নি তাঁদের ছবিতে। নন্দিতা ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রতিটি খুদে শিল্পীকে দিয়েছেন নিজস্ব আলোয় উজ্জ্বল হওয়ার পরিসর—যেখানে তারা শুধু উপস্থিত নয়, বরং গল্পের অপরিহার্য শক্তি হয়ে ওঠে। নন্দিতার কথায়, “আমাদের বহু ছবিতেই শিশু শিল্পীরা ছিল অপরিহার্য অংশ। ‘পোস্ত’, ‘কণ্ঠ’, ‘প্রাক্তন’  এবং আরও অনেক কাজেই তা দেখা গিয়েছে। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকেই আমরা অমূল্য শিক্ষা পেয়েছি, যা আমাদের সৃজনযাত্রাকে সমৃদ্ধ করেছে।”

শিশুদের জীবন এবং অনুভূতির বহু সূক্ষ্ম দিককে পরিচালকদ্বয় বারবার নিপুণভাবে তুলে এনেছেন পর্দায়। তাদের বেড়ে ওঠার মুহূর্তগুলোকে কেন্দ্র করে সাজিয়েছেন একের পর এক হৃদয়স্পর্শী ও তাৎপর্যপূর্ণ গল্প, যা দর্শকদের ভাবিয়ে তোলে। স্পর্শ করে। শিবপ্রসাদের কথায়, “আজও মনে পড়ে পোস্ত ছবির একটি মুহূর্ত। ছোট্ট অভিনেতার প্রশংসা করেছিলেন স্বয়ং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আর ঠিক সেই সময়েই, সম্পূর্ণ নিষ্পাপ ভঙ্গিতে শিশুটি বলে উঠেছিল, ‘সৌমিত্রদাও ওই দৃশ্যে ভাল অভিনয় করেছেন।’ সেই সরল, নির্ভেজাল কথাটি যেন শিশুমনের সত্যিকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছিল। যেখানে নেই অহঙ্কার, নেই ভেদাভেদ, আছে শুধু সমতা, আন্তরিকতা এবং হৃদয়ের নির্মলতা।”

উইন্ডোজ প্রোডাকশনের ‘রামধনু’, ‘হামি’, ‘হামি ২’-র মতো ছবির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়েছিলেন গার্গী রায়চৌধুরী। শিশু-কেন্দ্রিক এই গল্পগুলির অংশ হয়ে যেন আবার ফিরে গিয়েছিলেন নিজের শৈশবে। সেই যাত্রায় পেয়েছেন অনাবিল আনন্দ, নিষ্পাপ সব মুহূর্তের স্পর্শ। যেন এক টুকরো শৈশব ফিরে পাওয়া! তাঁর কথায়, “শিশুদিবস মানে আমার কাছে ‘হামি’ দিবস। ‘হামি’ করতে গিয়ে বা ‘রামধনু’ করতে গিয়ে মনে রয়েছে ওই রামধনুর মধ্যে যেন বাচ্চাদের মনের সাতটা রং আছে। অভিনয় করতে গিয়ে মনে হচ্ছিল ইশ! ছোটবেলায় আরেকটু দুষ্টুমি করতে পারলাম না! আমাদের ‘হামি ২’-তে একটা সংলাপ ছিল। ‘দুষ্টুমি করতাম কিন্তু দুষ্টু ছিলাম না।’ তাই বাচ্চাদের সঙ্গে কাজ করতে করতে আমরাও বাচ্চাই হয়ে যেতাম।”

শিশুদের সঙ্গে কাজ করতে করতেই আরও গভীর এক উপলব্ধি তৈরি হয়েছে গার্গীর। তাঁর কথায়, “ছোটদের সঙ্গে থাকতে থাকতে ভিতরের মাতৃসত্তাটা যেন বেরিয়ে আসে। তার জন্য আলাদা করে মা হতে হয় না। ওই শাসন, ওই আগলে রাখার প্রবণতা,  ‘হামি’র মতো ছবি এই অনুভূতিগুলো যেন লাল্টু আর মিতালিকে ফিরিয়ে দেয়।”