১৫ নভেম্বর, ২০২০।

সেদিন সংসারের সব মায়া ছিন্ন করে তিন ভুবনের পথে পাড়ি দিয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশ থেকে নিভে গিয়েছিল এক যুগান্তকারী নক্ষত্র, শূন্য হয়েছিল এক অদ্বিতীয় আসন—যে শূন্যতা আজও পূরণ হয়নি।

কিংবদন্তি অভিনেতার শেষ ছবি ‘বেলাশুরু’ তাই বাঙালির হৃদয়ে আজও আলাদা মর্যাদা পায়। কারণ, সৌমিত্রর প্রয়াণের পর সেই ছবিই তাঁকে শেষবারের মতো রুপোলি পর্দায় ফিরিয়ে এনেছিল—স্বপ্নের নায়ককে শেষবার দেখার সৌভাগ্য মিলেছিল দর্শকের। সৌমিত্রর চলে যাওয়ার পাঁচ বছর পরে, সেই স্মৃতিগুলো আরও তীব্র হয়ে ফিরে আসে গল্পকার জিনিয়া সেনের মনে—যিনি উইন্ডোজ প্রোডাকশনের অন্যতম সদস্য এবং যাঁর সৃষ্টিশীল যাত্রার বড় অধ্যায় জুড়ে রয়েছেন এই মহাতারকা।

জিনিয়া আজকাল ডট ইন-কে বলেন, “আমার লেখা কোনও গল্পে সৌমিত্রদা কাজ করেননি—এই আফসোসটা সর্বদা থেকেই যাবে। তবে উইন্ডোজের একাধিক প্রজেক্টে কাজ করতে গিয়ে তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্যও পেয়েছি।”

উইন্ডোজ প্রোডাকশনের সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যাত্রা শুরু ২০১৫ সালে। শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিতা রায় পরিচালিত ‘বেলাশেষে’-র হাত ধরে। এরপর ‘পোস্ত’, ‘বেলাশুরু’-র মতো ছবি উপহার দেয় দল। সেইসব কাজের সূত্রেই প্রয়াত অভিনেতার সঙ্গে এক বিশেষ সমীকরণ গড়ে উঠেছিল জিনিয়ার।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “‘বেলাশুরু’র শুটিংয়ের সময়ের একটা দৃশ্য আজও চোখের সামনে ভাসে। ‘ইনি বিনি টাপা টিনি’-র শুট শুরুর আগের প্রস্তুতি চলছে। আমরা সবাই মিলে ঘরে বসে আছি, আর সৌমিত্রদা গল্পে মাতিয়ে রেখেছেন সবাইকে। তিনি গল্প করতে ভীষণ ভালবাসতেন, আমরা শুনতেও। সেই সময় তিনিই স্বাতীদিকেও (স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত) ডাকলেন। কিন্তু দিদি আসেননি। বলেছিলেন, সৌমিত্রদার সঙ্গে দৃশ্যে নামার আগে নিজেকে একটু তৈরি করে নিতে চান। তাই গল্পে নয়, মন দেবেন প্রস্তুতিতে। স্নেহভরে আমায় বলেছিলেন, ‘কলকাতায় গিয়ে তোদের সঙ্গে গল্প করব।’ অথচ ওদিকে সৌমিত্রদা তখন আমাদের একেবারে মাতিয়ে রেখেছেন।”

কাজের পরিধির গণ্ডি ছাপিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন তাঁদের আপনজন। তাই শুধু শুটিং ফ্লোরেই নয়, শিবপ্রসাদ এবং জিনিয়ার বাড়িতেও মাঝেমধ্যেই জমত আড্ডার আসর। সেসব মুহূর্তে তিনি খুলে বসতেন স্মৃতির ঝুলি—পুরনো দিনের গল্প, অভিজ্ঞতার নানা মণিমুক্তো, জীবনের অনাবিল সঞ্চয়। আর সেইসব কথায় মুগ্ধ হয়ে থাকতেন তাঁর স্নেহধন্য মানুষরা। জিনিয়া বলেন, “শিবপ্রসাদের কাছে গল্প শুনেছিলাম। নিজের সঙ্গে একটি লাল ডায়েরি রাখতেন সৌমিত্রদা। ওখান থেকে দেখে ফাঁকা ডেট দিতেন শুটিংয়ের জন্য। একদিন সেই ডায়েরিতে একটি তারিখের সঙ্গে একটা ফুল আঁকা আছে। খুব অবাক হয়েই শিবপ্রসাদ জানতে চেয়েছিল ওই দিনটায় বিশেষ কিছু আছে কি না। সৌমিত্রদা জানিয়েছিলেন ওই দিন ওঁর আর দীপা (চট্টোপাধ্যায়) বৌদির বিবাহবার্ষিকী। তাই সেই দিনটা তিনি আর কাউকে দেবেন না। তুলে রেখেছিলেন শুধুমাত্র দীপা বৌদির জন্য।”

সৌমিত্র চট্টোপাধায়কে কেন্দ্র করে কোনও জীবনীচিত্র নির্মাণের ভাবনা আছে কি? আর থাকলে, পর্দায় তাঁকে ফুটিয়ে তুলতে কাকে বেছে নেবেন—এই স্বাভাবিক কৌতূহল থেকেই জিনিয়ার কাছে প্রশ্ন রেখেছিল আজকাল ডট ইন। জিনিয়ার মতে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাজের বিশাল ব্যপ্তি ও বহুমাত্রিক জীবনকে পর্দায় ধারণ করা সত্যিই দুষ্কর। তাঁর জীবন, সুদর্শন চেহারা, মূল্যবোধ, অভিনয়ের নান্দনিকতা, বাচনভঙ্গি—কোনওটিই অনুকরণ বা পুনর্নির্মাণ করা সম্ভব নয়। তাই তাঁর জীবনকে চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়া যেমন কঠিন, তেমনই পর্দায় তাঁর সমতুল্য কাউকে কল্পনা করাও প্রায় অসম্ভব। তাঁর কথায়, “তবু যদি ভাবতে হয়, সৌমিত্রদার চরিত্রে পরমব্রতকে (চট্টোপাধ্যায়) ভাবতে পারি। কারণ ওদের চেহারায় কিছুর সাদৃশ্য আছে। পরমব্রতর চেহারাও সৌমিত্রদার মতো সৌষ্ঠব। ও সৌমিত্রদার মতো খুব ভাল বাংলা আর ইংরেজি বলতে পারে। তাই এই মুহূর্তে ওর কথাই মাথায় এল।”

জিনিয়ার কাছে সৌমিত্র শুধু নায়কই নন, তিনি অনুভূতির গভীরে ‘অপু’ হিসেবে রয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেন, “রাজা লিয়ার দেখে আমি শিবপ্রসাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ওঁর চোখে ঈশ্বর কেমন দেখায়। তখন উনি আমাকে একই প্রশ্ন করেছিলেন। আমি উত্তর দিয়েছিলাম, ‘রাজা লিয়ার’-এর সৌমিত্রদার মতো।”