প্রায় পাঁচটা বছরের হাপিত্যেশ অপেক্ষা। অবশেষে আবার সে এসেছে ফিরিয়া। এবং যথারীতি এসেছে, দেখেছে এবং জয় করে ছেড়েছে হিম্মত সিং। জিও হটস্টারের জনপ্রিয় স্পাই থ্রিলার সিরিজ ‘স্পেশাল অপস’-এর কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা, ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি র’-এর তুখোড় অফিসার। তবে এবারে বাস্তবের ময়দান ছেড়ে ছায়াযুদ্ধে রণকৌশল সাজিয়েছে হিম্মত। কারণ সশরীরে যুদ্ধ নয়, এবারের শত্রুরা দেশের ক্ষতি করতে উঠে পড়ে লেগেছে সাইবার ওয়ারফেয়ারের হাত ধরে। দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা হিম্মতের নিজের হাতে বাছাই করা স্পাই-চক্র এবং দিল্লির অফিসের দলবল তাই ডিজিটাল যুদ্ধকে হাতিয়ার করেই নেমেছে সম্মুখ সমরে।
কোভিড-লকডাউনের দিনগুলোয় ২০২১-এ মুক্তি পায় ‘স্পেশাল অপস’। এ দেশে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ ঠেকাতে দুনিয়া জোড়া অপরাধের জালে স্পাই থ্রিলারের রোমহর্ষক কাহিনি, টানটান চিত্রনাট্য, দুরন্ত সিনেম্যাটোগ্রাফি এবং বলিষ্ঠ অভিনয় তখনই চমকে দিয়েছিল দর্শককে। তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে একই বছরে মুক্তি পায় গল্পের প্রিক্যুয়েল ‘স্পেশাল অপস ১.৫’। তাতে হিম্মত সিংয়ের (কে কে মেনন) কেরিয়ার সফর ফিরে দেখিয়েছিলেন পরিচালক জুটি নীরজ পাণ্ডে এবং শিবম নায়ার। তারপর প্রায় বছর পাঁচেকে অনেকটা পাল্টে গিয়েছে পৃথিবী। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), মেশিন লার্নিং, রোবোটিক্সের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি রোজকার জীবনযাপন থেকে পেশা কিংবা নেশা, সব কিছুকেই আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে সাইবার দুনিয়ায়। আর তারই হাত ধরে ক্রমশ থাবা চওড়া হচ্ছে ডিজিটাল অপরাধের। এই পাল্টে যাওয়া পৃথিবীর চাহিদা মেনে স্পাই থ্রিলারের ছকও আমূল বদলে ফেলেছেন পরিচালক-কাহিনিকারেরা। দ্বিতীয় সিজনের প্রেক্ষাপট তাই সাইবার যুদ্ধের হাত ধরে এদেশের নিরাপত্তাকে নড়বড়ে করে ফেলে আমজনতার উপরে আক্রমণ শানানোর কাহিনি।

গল্পের শুরুতেই এআই নিয়ে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মঞ্চ থেকে অপহৃত হন জগৎবিখ্যাত ভারতীয় সাইবার বিশেষজ্ঞ ডক্টর পীযূষ ভার্গব (আরিফ জাকারিয়া), যাঁর এ দেশের শক্তি, নিরাপত্তা, অর্থনীতি-সহ নানা বিপুলায়তন সরকারি প্রকল্পের সাইবার-সুরক্ষার চাবিকাঠি। একই সময়ে দিল্লিতে আততায়ীর গুলিতে নিহত হয় ভার্গবের নিরাপত্তায় নজরদারির ভারপ্রাপ্ত ইন্টেলিজেন্স অফিসার বিনোদ শেখাওয়াত (টোটা রায়চৌধুরী)। পরিস্থিতি সামাল দিতে আসরে নামে হিম্মত ও তার স্পাই বাহিনি। অন্যদিকে, হিম্মতের একদা গুরু (প্রকাশ রাজ) অতীতে বড়সড় এক ব্যাঙ্ক জালিয়াতির জেরে টাকার অভাবে স্ত্রীকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার প্রতিশোধ নিতে হাজির। হিম্মতকে তিনি হুঁশিয়ারি দেন, ঠিক সাত দিনের মধ্যে সেই ব্যাঙ্ক জালিয়াত জিগনেশ ঢোলাকিয়াকে শায়েস্তা করতেই হবে। তা না হলেই ঘোর বিপদ সামনে! আর এসবের মধ্যেই দর্শকের একটু একটু করে পরিচয় হতে থাকে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা এক আন্তর্জাতিক ব্যবসার একচ্ছত্র অধিপতি সুধীর অবস্থির (তাহির রাজ ভাসিন) সঙ্গে, তাঁর নিষ্ঠুরতা ও শীতল চাহনির সঙ্গে। প্লটের পর প্লট পেরিয়ে সিরিজের গল্প দিল্লি থেকে পাঁই পাঁই ছোটে সার্বিয়া, জর্জিয়া, স্লোভেনিয়া, ডমিনিকা, দুবাই, পাকিস্তান-সহ একের পর এক দেশের চোখজুড়োনো অলিগলি-রাজপথ ধরে। সব দিক সামলে, অদৃশ্য শত্রু এআইয়ের সঙ্গে লড়ে, কর্পোরেট দুনিয়া আর রাজনীতির আঁতাতের জট পেরিয়ে হিম্মত কি পারবে ডক্টর ভার্গবকে ফিরিয়ে এনে এ দেশের সুরক্ষা অটুট রাখতে? জিগনেশ ঢোলাকিয়া (হিতেশ দাভে) পাবে তার যোগ্য সাজা? এসবের সঙ্গে সুধীরই বা ঠিক কীভাবে জড়িয়ে? সব উত্তরই রাখা আছে সিরিজের পরতে পরতে।
সিজন ১ কিংবা সিজন ১.৫-এর গল্প এগিয়েছিল নির্দিষ্ট এক লক্ষ্যকে পাখির চোখ করে। ফলে সরল রেখায় না চললেও গল্পের ভাঁজে ভাঁজে কখনও বাড়তি বোঝা তৈরি হয়নি। এবারের সিরিজ সে জায়গাটায় খানিক কমজোরি বলা চলে। একই রান্নায় এত রকম উপকরণ মেশাতে গিয়ে প্লটের বিষয়টা বড্ড জটপাকানো হয়ে দাঁড়িয়েছে কোথাও কোথাও। আর তাই বোধহয় আগের মতো মগজাস্ত্রের জাদুতে পুরোপুরি আস্থা না রেখে এবারের সিজনে হিম্মতের চরবাহিনীর কাছে পেশীশক্তিই হয়ে উঠেছে প্রধান হাতিয়ার। এমনটা নিশ্চিত ভাবেই খানিকটা অপ্রত্যাশিত ঠেকে। বলা ভাল, লম্বা লম্বা অ্যাকশন দৃশ্য, হানি ট্র্যাপের চেনা ছক কিছুটা ক্লান্তিকরই লাগে যেন।
এবারেও চোখধাঁধানো সিনেম্যাটোগ্রাফির পাশাপাশি জমাটি অভিনয় অবশ্য সেই আগের মতোই। হিম্মত-রূপী কে কে মেনন যথারীতি তাঁর বলিষ্ঠ এবং পরিমিত অভিনয়ে দুরন্ত। গল্পের প্রতিটা মোড়ে যিনি নিজেকেই ছাপিয়ে যান যখন তখন। সেয়ানে সেয়ানে টক্কর দেন তাহিরও। যাঁর স্রেফ চাহনিতেই ছড়িয়ে যায় নৃশংসতার বার্তা। অযথা রক্তপাতের বদলে এক্কেবারে এ যুগের ভিলেন হয়ে যিনি আস্থা রাখেন ভার্চুয়াল মহারণে। বদল নয় বদলা চাওয়া, আমজনতার ভিড়ে থেকেও আলাদা হয়ে ওঠা এক চরিত্রে প্রকাশ নজর কাড়েন তাঁর মতো করে। জিগনেশ-রূপী হিতেশকেও বিশ্বাসযোগ্য লাগে। ফ্ল্যাশব্যাকের অল্প কিছু দৃশ্যে নিজের জাত চেনালেও টোটার তেমন কিছু করার ছিল না যদিও। যেমন অ্যাকশন ছাড়া এ সিরিজে তেমন কিছু করার ছিল না হিম্মতের এজেন্ট-কুল ফারুক (করণ ত্যাকার), অবিনাশ (মুজাম্মিল ইব্রাহিম), জুহি (সায়ামি খের) বা রুহানি(শিখা তালসানিয়া)-দের। তবে যথারীতি নজর কেড়ে ছাড়ে দিল্লি পুলিশের অফিসার আব্বাস (বিনয় পাঠক) কিংবা হিম্মতের দুই র’ সহকর্মী চাড্ডা (পরমিত শেঠি) এবং ডি কে ব্যানার্জি (কালীপ্রসাদ মুখার্জি)-র চরিত্রগুলো।
তবে গল্পে হিম্মতের হিম্মত যখন চমকে দিচ্ছে স্বয়ং দেশের মন্ত্রীকেও, তার উল্টো পিঠে এক অসহায় বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় দর্শকের। হিম্মত ও স্ত্রী সরোজের (গৌতমী কাপুর) হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও মেয়ে পরী (রেবতী পিল্লাই) জেনেই ফেলে অতীতের লুকনো সত্যি। মেয়েকে কি তবে দূরে ঠেলে দেবে সত্যির বোঝা, সে ভয়ে কুঁকড়ে থাকা হিম্মতকে যেন বড্ড চেনা লাগে। বুদ্ধিমত্তা আর কাঠিন্যে গড়া তুখোড় ইন্টেলিজেন্স অফিসার সেখানেই বোধহয় পৌঁছে যান দর্শক মনের আরও কাছাকাছি!
