আকাশ দেবনাথ: যুদ্ধ ঠিক কাদের? যারা যুদ্ধ করে তাদের, নাকি যারা যুদ্ধ করায় তাদের? দুর্ভাগ্যের কথা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের কাছেই নাকি এই প্রশ্নের উত্তর নেই। সোজা ভাবে বললে, উত্তরটা চোখের সামনে ঝুলন্ত গাজরের মতো দোলালেও দেশের বহুসংখ্যক মানুষই স্বেচ্ছায় অন্ধ হয়ে থাকবেন। কারণ আসলে তাঁরা মনে মনে ঠিকই জানেন, এই রাষ্ট্রের নেতারা তাঁদেরই মতো, ঠিক তাঁদের ভেতরের নর্দমায় ডুব দেওয়া আত্মার মতোই কালো। এই যুদ্ধে আসলে সবাই সমান অংশীদার।
ধর্ম? কিসের ধর্ম? কোন ধর্মে ৩০০ বছর আগে মারা যাওয়া রাজার কবর খোঁড়ার নির্দেশ আছে? নোংরা ঠাট্টার মতো শোনাচ্ছে না? তালিবানরা সোল্লাসে বুদ্ধ মূর্তি ভেঙে মহাগর্বের কাজ করেছিল? নাকি পাশের দেশে দেশনায়কের মূর্তির মাথায় প্রস্রাব করে ধর্মের পবিত্র পানিতে জন্নত নসীব হয়েছিল বর্বরদের? এর নেপথ্যে না আছে ধর্ম, না আছে নীতি। আছে ক্ষমতার আর শয়তানির দেখনদারি। নয়তো একথা মূর্খেও বোঝে, চলচ্চিত্র কখনও তিনশো বছর পুরনো ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য বয়ানবাজির জায়গা হতে পারে না। সে ছবি হাজার হাজার কোটির ব্যবসা করলেও না। কারণ ইতিহাস নিজেই একমাত্রিক না। ইতিহাস শুধু এবং শুধুমাত্র স্মৃতিরক্ষার গোষ্ঠীগত প্রয়াস। তাও ‘শিক্ষিত’ লোকের হাতে। কেউ তার থেকে শিক্ষা নিতে পারে। কিন্তু কেউ যদি সদম্ভে কয়েকশো বছর পর ঐতিহাসিক কালরেখার দিক পরিবর্তনের চেষ্টা করে তবে তার একমাত্র জায়গা পাগলাগারদ কিংবা পুলিশের সেল। হয় সে অসুস্থ নয় সে ক্রিমিনাল।
অথচ এমন করুণ পরিস্থিতির মধ্যেও খেদোক্তির মতো হাসির উদ্রেক হয়। কারণ এই অসুস্থতা ব্যক্তিগত নয়, গোষ্ঠীগত। গণ হিস্টেরিয়ার মতো, দাবানলের মতো, সংক্রামক ব্যাধির মতো। পাগলকে পাগলা গারদে ভরবে যে ডাক্তার, সেও সংক্রামিত। যে পুলিশ ক্রিমিনালদের সেলে ভরবে তার মুখেও রোগের অট্টহাসি। সফল রাষ্ট্রযন্ত্রের নিখুঁত ইনজেকশনে একটা গোটা দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গিয়েছে হিস্টেরিয়ার বিষ। গণঅভ্যুত্থানের ঋণাত্বক রূপ যেন। কী বলা যায় তাকে গণঅধঃপতন?
যিনি এই ছবির নায়ক, তিনি ছবি প্রচারের কালে সগর্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন ঐতিহাসিক চরিত্রে। তিনি অভিনেতা, অভিনয় তাঁর পেশা। তাঁর কাছে এহেন ব্যবসায়ীবৃত্তি অপ্রত্যাশিত নয়। নিজের অভিনীত চরিত্রের বিক্রয়ে তিনি ‘কৌশল’-এর কসুর করেননি। এখন তো তাঁকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তাঁর স্ত্রীও নাকি ওই মৃত রাজার মতোই একই ধর্মের। কেউ কেউ সেজন্য নাকি তাঁর থেকে বাড়তি সংবেদন আশা করেছিলেন। ফের হাসির উদ্রেক হয়। পুরুষের যুদ্ধে নারীর অস্তিত্ব? সে তো খালি দখলদারির প্রশ্নে। নীতির প্রশ্নে নারীর অস্তিত্ব আর অধিকারের প্রশ্নে এদেশের ভিখারী শূদ্রের জায়গার বস্তুত কোনও তফাৎ নেই।
আর যারা তাঁকে গ্রহণ করেছে তারা? তাদের যাঁরা চালনা করছেন তাঁরা? ভিড় এবং ভিড়ের পেছনের মাথাদের প্রশ্ন করার ধক কারও আছে? এক কথায় উত্তর হল- নেই। এই ভিড় উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির সাদা বহুতলের ভিত। স্বদেশের পর্দার আড়ালে ন্যাংটো রাষ্ট্রযন্ত্রের বর্তমান এখন এটাই। কারও ক্ষমতা নেই সেই বাড়ির কাচের জানালায় ঢিল ছোড়ার। কারণ সেই ভিড়। অর্ধমৃত শ্বাপদের মতো সেই ভিড় দাঁত নখ দিয়ে আক্রমণ করে যে কোনও প্রশ্নকারীকে। মরা সম্রাট ভাল না মন্দ, তাঁর কবর কাঁচা না পাকা, তাঁর বাপ ঠাকুরদা স্বদেশী না বিদেশি, এসব প্রশ্নের বাইরে আর কোনও প্রশ্ন অসম্ভব এই বর্তমানে। তাই দেশের স্বাস্থ্য চলে যায় পার্মানেন্ট ভবিষ্যতে আর অতীত টেনে আনা হয় মর্গ থেকে। মাঝখানের দুষ্টু ‘আজকের দিন’ ভ্যানিশ!
