রণবীর সিং-এর কামব্যাক। অক্ষয় খান্না, সঞ্জয় দত্ত, অর্জুন রামপাল-এর মতো বাঘা বাঘা অভিনেতা। গুপ্তচরদের কাণ্ডকারখানা। টানটান বিতর্ক এবং অবশ্যই ভারত-পাকিস্তানের দ্বৈরথ। ওহ, সঙ্গে জাতীয়তাবাদের ফোড়ন! কোনও একটি ছবিতে যদি এত রকম মশলা মজুদ থাকে, সেই রান্নার স্বাদ শেষমেশ কেমন হবে, তা চাখার স্বাদ তো থাকবেই। ‘ধুরন্ধর’-এর মুক্তির আগেই আগ্রহের পারদ সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছিল। 


বক্স অফিসের দিকে এক ঝলক তাকালে বোঝা যাবে 'ধুরন্ধর'-এর জন্য অপেক্ষা সার্থক হয়েছে দর্শকের। ‘রকি ঔর রানি কি প্রেম কহানি’ ছবির উজ্জ্বল, রোম্যান্টিক থেকে এমন এক নির্মম, সংযত, রক্তমাখা চরিত্রে নিজেকে এতটা ভাঙা - রণবীরের খুব ভেবেচিন্তেই নেওয়া সিদ্ধান্ত বলেই মনে হয়।  

 

‘ধুরন্ধর’ কোনও হালকা অ্যাকশন থ্রিলার নয়। বন্দুকের গর্জন, রক্তের গন্ধ ও একাধিক দেশের পরস্পরের সঙ্গে শ্যাডো-ওয়ারের ভয়ঙ্কর বাস্তবতা- এই তিন স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এক বিস্তৃত স্পাই-ড্রামা। আটটি অধ্যায়ে ভাগ করা ছবির প্রথম দৃশ্য থেকেই একটি সন্ত্রাসবাদী হামলা দর্শককে সোজা গল্পের ভিতরে টেনে নেয়। 

 

‘ধুরন্ধর’ কোনও একক ইতিহাস বা ব্যক্তির গল্প নয়। ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা 'র' (RAW)-এর একাধিক গোপন অপারেশন, ১৯৯৯-এর কান্দাহার হাইজ্যাক, ২০০১-এর সংসদ হামলা, অপারেশন লেয়ারি, ২৬/১১—এই সব বাস্তব ঘটনার অনুপ্রেরণা ছবির রক্তে মিশে আছে। তবে জোর দিয়ে বলা দরকার, এই ছবি মেজর মোহিত শর্মার জীবনের উপর ভিত্তি করে নয়। বরং এটি দেখায় প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক খেলাঘর, করাচির আন্ডারওয়ার্ল্ড, রাস্তাঘাটের বাস্তবতা যা কোনও না কোনওভাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত।

 

৩ ঘণ্টা ৩৪ মিনিটের ছবির দৈর্ঘ্য কাগজে-কলমে অথবা লোকের মুখে শুনলে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে সময়টা বৃথা যায় না। ‘ধুরন্ধর’ ২০২৫-এর অন্যতম সবচেয়ে বড় ও সাহসী মুক্তি, নির্মাতাদের এই দাবি অমূলক নয়। এটি সরাসরি সশস্ত্র বাহিনীর গল্প নয়, বরং সেই মানুষগুলোর কথা বলে যারা নীরবে যুদ্ধ করে, নিজের নাম, পরিচয়, এমনকী ব্যক্তিগত জীবন বিসর্জন দিয়ে দেশের জন্য কাজ করে। 

 

এই জটিল, অন্ধকার জগতে রণবীর সিংহ এক কথায় অনবদ্য। সংযত আবেগের দৃশ্যে তিনি অসামান্য। অনুভূতিসম্পন্ন এক হত্যাযন্ত্র হয়ে ওঠা সহজ নয়, কিন্তু রণবীর সেটা করেন নিখুঁত ভারসাম্যে -কখনও নির্মম, কখনও বুদ্ধিদীপ্ত, কখনও আবার একেবারে অপ্রত্যাশিত। এটাই সম্ভবত তাঁর কেরিয়ারের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স। তবে রণবীর অভিনীত ‘শামসের’ চরিত্রের একটি গোপন গল্প রয়েছে, যা এই চরিত্রটিকে গোটা ছবি জুড়ে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। 

 


বাকি অভিনেতারাও কোথাও ভিড় হয়ে ওঠেন না। অর্জুন রামপাল সীমিত স্ক্রিন টাইমেও দারুণ প্রভাব ফেলেন পর্দায়। সঞ্জয় দত্ত, আর মাধবন ও রাকেশ বেদির উপস্থিতিও গল্পকে আরও বেশি গভীর করে তোলার পাশাপাশি দর্শককে আসনের সঙ্গে জুড়ে রাখে। এই ছবিতে ‘টু মেনি অ্যাক্টরস’ বলে কিছু নেই, কারণ প্রতিটি চরিত্রের গুরুত্ব এই গল্পের জন্য অপরিসীম। এবং অক্ষয় খান্না। তাঁর অভিনীত দুঃসাহসী, নির্মম, ভারত দ্বেষী এই ‘রেহমান বালোচ’-কে দেখে দর্শক যতটা শিউরে উঠবেন, ততটা তাঁর ব্যক্তিত্ব দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। ছবিতে অক্ষয়ের প্রধান অস্ত্র তাঁর চোখ। তাতে  সীমাহীন বেপোরয়ার সঙ্গে মিশে রয়েছে নিষ্ঠুরতা, ধূর্ততা। আবার ফুটে ওঠে ভালবাসাও! পর্দায় অক্ষয় যতবার এসেছেন, ততবার শুধু তাঁর দিকেই চোখ গিয়েছে দর্শকের। সেই সময়ে যতই পর্দার বাকি অর্ধেক অংশ জুড়ে থাকুক রণবীর, সঞ্জয় দত্ত কিংবা অর্জুন রামপাল! কুর্নিশ আদায় করে নিয়েছেন বর্ষীয়ান অভিনেতা রাকেশ বেদি ।বহু, বহু বছর পর বড়পর্দায় দেখা গেল তাঁকে। এবং তিনি এলেন, দেখলেন, জয় করলেন! সাফ কথা।  


‘উরি’ ছবি খ্যাত পরিচালক আদিত্য ধর আবারও প্রমাণ করলেন, তাঁর গল্প বলার দক্ষতা আলাদা। ‘উরি’ ছবির পর ধুরন্ধর যেন আরও গভীরে যাওয়া এক প্রয়াস। তবে হ্যাঁ, ছবির কোনও দৃশ্য বা সংলাপ অকারণে ঢোকানো যেমন হয়েছে, তেমনই ছবি থেকে মাঝেমধ্যেই গন্ধ বেরিয়েছে ঈষৎ উগ্র জাতীয়তাবাদের। যশ রাজ ফিল্মসের স্পাই-ইউনিভার্সের মতো স্টাইলিশ কিংবা ঝকঝকে নয় ধুরন্ধর। বীভৎসতা, মাটির কাছাকছি হলেও এ ছবি এড়াতে পারেনি বলিউডের চিরচেনা ব্যাকরণ। দুই শত্রুপক্ষের ছেলেমেয়ের প্রেম ।তা এক পক্ষ যতই দেশের জন্য ‘গোপন মিশন’-এ আসুক না কেন! এখানেও ‘স্পাই’ রণবীরের সঙ্গে প্রেম হয় পাকিস্তানের এক বিধায়ক (রাকেশ বেদি)র কন্যার। দেখা যায়, পাহাড়ের কোলে, উপত্যকার বুকে বহতা হুয়া ছোট্ট মেয়ের মতো নদীর পাশে রোম্যান্টিক গান গাইতে। 

 

তবে আলাদা করে সাধুবাদ জানাতে হয় ছবির আবহসঙ্গীতকে। এবং কালারিস্টকে। দুরন্ত কাজ হয়েছে এই বিভাগে। যতটা সুন্দর বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে ছবিতে থাকা আন্তর্জাতিক মানের অ্যাকশন সিকোয়েন্সের। ছবিতে অ্যাকশন আছে, রয়েছে গতি কিন্তু তা সবসময় হাত ধরাধরি করে চলেনি। কিন্তু যখন পরস্পরের হাত ধরেছে দর্শক আরও টানটান হয়ে বসেছেন নিজের আসনে। 

 

ছবির শেষটা এমনভাবে আসে যে, সিক্যুয়ালের জন্য মনটা নিজে থেকেই তৈরি হয়ে যায়। প্রেক্ষাগৃহে যাওয়ার দর্শকদের জন্য ধুরন্ধর নিঃসন্দেহে ভ্যালু ফর মানি - রোমাঞ্চ, স্কেল আর অভিনয়ের এক মুচমুচে প্যাকেজ।