বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের প্রশ্ন যখন ফের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির কেন্দ্রে উঠে এসেছে, ঠিক তখনই  মঞ্চে দেখা গেল এক ভিন্ন আঙ্গিকের শিল্পপ্রকাশ। গত ১৫ আগস্ট, ২০২৫, ৭৯ তম স্বাধীনতা দিবসে মধ্যমগ্রাম নজরুল মঞ্চে পরিবেশিত হল এক অনন্য শ্রুতিদৃশ্যায়ন— ‘দেশছাড়া দেশহারা’।

এই শ্রুতিদৃশ্যায়নের প্রযোজক ‘কলকাতা কল্পক’, আর এর মূলে রয়েছে কবি অংশুমান করের দীর্ঘ ডকু কবিতা “দেশছাড়া দেশহারা”। কবিতার পরতে পরতে ধরা পড়েছে দেশভাগোত্তর কাল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এপার-ওপার বাংলার মানুষের বাস্তুচ্যুত জীবনের আখ্যান। সেই কাব্যই এদিন মঞ্চে রূপ নিল আবৃত্তি, অভিনয়, সংগীত, আলোকসজ্জা ও নৃত্যের এক সম্মিলিত মেলবন্ধনে।

 

১ ঘণ্টা ১০ মিনিটের প্রযোজনাটির কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে উঠে এলেন মহাত্মা গান্ধী— যিনি প্রথম থেকেই দেশভাগের বিরোধিতা করেছিলেন। মঞ্চ দেখালো কীভাবে রাজনৈতিক স্বার্থ আর মুনাফার খেলায় দাঙ্গা লাগানো হয়েছিল, কীভাবে হাজারো মানুষ স্বপ্নভঙ্গের শিকার হয়েছিলেন। মুনাফার চরিত্রটি মঞ্চে জীবন্ত হয়ে উঠল আবৃত্তি ও নৃত্যের মিশেলে।

আরও পড়ুন:  ‘ইনসান, জানোয়ার আর এবার হেওয়ান…’ অক্ষয়-সইফের কামব্যাক ছবির শুটিং শুরুর দৃশ্য দেখলেই চমকে উঠবেন!

সাইক্লোরামার পর্দায় যখন ভেসে উঠছিল দাঙ্গার বিভীষিকাময় ছবি, তখন দর্শক আসন যেন একাত্ম হয়ে যাচ্ছিল সেই ভয়াল সময়ের সঙ্গে। কিশোরগঞ্জের ট্রেনের দৃশ্য—যেন সোজা ঢুকে পড়ছিল দর্শকের বুকের ভেতর। আবৃত্তি, প্রজেকশন আর আলোর অসাধারণ সমন্বয়ে এই নির্মাণ দাঁড়িয়ে রইল এক অনন্য অভিজ্ঞতায়।

 

 

কাব্যের আখ্যান বলছে—

দেশ ছেড়ে পালানোর সময় ভিড়ের চাপে এক শিশুর মৃত্যু,

দেশভাগের পর নিজের ধর্মীয় পরিচয় জেনে আত্মহত্যা করা ইসমাইলের করুণ কাহিনি—
সবই রূপ পেল কাব্যিক দৃশ্যায়নে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উচ্চারিত হল মানবতার সুর— “ধর্মপরিচয়ের চেয়ে বড়ো মানবিকতা”।

প্রযোজনার শিল্পরূপের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল এর বহুমাত্রিক ভাষা। কখনও কবিতা মিশেছে সংগীতে, সংগীত মিশেছে নাটকে, নাটক অন্বিত হয়েছে নৃত্যের ভঙ্গিমায়। আর এই সবের সঙ্গে ছিল সৌমেন চক্রবর্তীর অনবদ্য আলোকসজ্জা— যা প্রযোজনাটিকে পৌঁছে দিল এক নতুন মাত্রায়।

পরিচালক গার্গী সেনগুপ্ত ও তরুণ ভট্টাচার্য শুধু প্রযোজনা সাজাননি, নিজেরাও আবৃত্তি ও অভিনয়ে অংশ নিয়েছেন। ফলে “দেশছাড়া দেশহারা” নিছক একটি পরিবেশনা নয়, হয়ে উঠল দলগত সৃজনশীলতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

এই অস্থির সময়ে, যখন সীমান্তপারের প্রশ্ন আবার রাজনীতির আলোচ্য, তখনই এমন এক শিল্পপ্রয়াস মনে করিয়ে দিল— বিভাজনের থেকেও বড়ো সম্প্রীতি, ভয় ও ঘৃণার থেকেও বড়ো মানবিকতা।