আজকাল ওয়েবডেস্ক: কল্পনা করুন, কোনও বাচ্চা ঘুম থেকে উঠে স্মার্টফোন দেখছে, হয়তো কিছু রিল স্ক্রল করবে। পরে, তার বাবা তাকে স্কুলে নামানোর জন্য নতুন ইলেকট্রিক স্কুটারটি চালাচ্ছে। বাচ্চাটির স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক গ্রহকে বাঁচানোর জন্য বায়ুশক্তির উপর একটি তথ্যচিত্র দেখাচ্ছে। সব কিছু স্বাভাবিক শোনাচ্ছে, তাই না? কিন্তু এখানে কিছু অদ্ভুত জিনিস আছে, কিছু বিশেষ ধাতু ছাড়া এগুলির কিছুই কাজ করে না। যার নাম বেশিরভাগ মানুষ কখনও শোনেননি। এগুলোকে বিরল পৃথিবী খনিজ বলা হয়। এগুলিই এখন ভারতের সবচেয়ে বড় গোপন সমস্যা।
বিরল পৃথিবী খনিজের কথা মার্ভেলের সিনেমাতে শোনা যায় প্রায়শই। কিন্তু বাস্তবজীবনে এ রকম ১৭টি ধাতু রয়েছে। যেগুলির নাম উচ্চারণ করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। যেমন, নিওডাইমিয়াম এবং ডাইসপ্রোসিয়াম। আপনার ফোনের স্পিকার, বৈদ্যুতিক যান, যুদ্ধবিমানের রাডার সবেতেই ধাতুগুলি অপরিহার্য। এগুলি হীরের মতো বিরল নয়। সমুদ্রসৈকতের বালি এবং পাথরেও পাওয়া যায়। কিন্তু সেখান থেকে ধাতুগুলির নিষ্কাশন প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং ব্যয়বহুল।
ভারতের এই ধাতুগুলির প্রচুর প্রয়োজন। কেন্দ্র ২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষ লক্ষ বৈদ্যুতিক যানবাহন তৈরির কথা বলছে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বশেষ প্রযুক্তির প্রয়োজন। কিন্তু কেন্দ্র দেশের প্রয়োজনের ৯৫ শতাংশ অন্য দেশ থেকে কেনে। কেরল এবং ওড়িশার সমুদ্র সৈকতে বিরল ধাতু উপলব্ধ থাকলেও সেখানে খনন করা হয় না। সবচেয়ে অস্বস্তিকর দিকটা কী? এর বেশিরভাগই আসে চীন থেকে। যে দেশের সঙ্গে আমাদের সীমান্তে উত্তেজনা ছিল। ২০২২ সালে চীন ভারতের বিরল খনিজ ধাতুর আমদানির ৮১ শতাংশ রপ্তানি করেছিল। এটা অনেকটা বড় ম্যাচের আগে ব্যাট ধার দেওয়ার জন্য আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিকেট দলের উপর নির্ভর করার মতো।
কেন চীন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে? কারণ, তাদের আছে এই ধাতুগুলির বিশাল ভাণ্ডার এবং বিশ্বব্যাপী প্রক্রিয়াকরণের ৯০ শতাংশে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। কীভাবে? উত্তরটা সহজ, সস্তা শ্রম, বিশাল সরকারি তহবিল। ভারতের ইন্ডিয়ান রেয়ার আর্থস লিমিটেড (আইআরইএল) নামক সরকারি সংস্থা ১৯৫০ সাল থেকে কাজ করছে। আইআরইএল কেরল, ওড়িশা এবং তামিলনাড়ুর সমুদ্র সৈকতের বালি থেকে বিরল মাটি উত্তোলন করে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী সরবরাহের মাত্র ২ শতাংশ উৎপাদন করে। আইআরইএল থোরিয়াম, টাইটানিয়াম ডাই অক্সাইড এবং কিছু বিরল ধাতুর যৌগ তৈরি করে। যা ভারতের বিশেষ কাজে লাগে না। এছাড়াও এদেশে অনুমতি পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। মনে আছে ২০১০ সালে চীন যখন জাপানে বিরল ধাতু সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল? রাতারাতি দাম দশগুণ বেড়ে যায়! তারা বাণিজ্য যুদ্ধে বিরল ধাতুকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শিখেছে।
চীন যদি হঠাৎ এই ধাতু সরবরাহ বন্ধ করে দেয় গোটা বিশ্বের জন্য। ২০২৫ সালের এপ্রিল এবং অক্টোবরে মাইক্রোচিপ এবং প্রতিরক্ষায় ব্যবহৃত কিছু বিরল ধাতুর উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। সেপ্টেম্বরে কিছু রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে সাময়িক স্বস্তি দিয়েছে বিশ্বকে। কিছু নিয়ম শিথিল করছে এবং অন্যগুলিকে কঠোর করছে। সরবরাহ সম্পূর্ণ থেমে গেলে ভারতের জন্য দুঃস্বপ্ন। দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাবে। বৈদ্যুতিক স্কুটারের দাম ২০-৩০ শতাংশ বাড়বে। টাটা এবং মাহিন্দ্রার মতো গাড়ি সংস্থাগুলির এই বছরই ৮৭০ টন বিরল খনিজ চুম্বকের প্রয়োজন। এগুলো ছাড়া গাড়ি তৈরি হবে না। হাজার হাজার শ্রমিক চাকরি হারাতে পারেন।
পরিষ্কার বিদ্যুৎ উৎপন্নকারী বায়ু টারবাইনগুলির জন্য ডিসপ্রোসিয়াম প্রয়োজন। এটি ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ গিগাওয়াট পরিবেশবান্ধব শক্তির আমাদের স্বপ্ন ভেঙে যাবে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ অংশটি হল প্রতিরক্ষা। আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র, নাইট-ভিশন সরঞ্জাম, রাডার সিস্টেম সকলেরই বিরল খনিজের প্রয়োজন। ভারত ইতিমধ্যেই বিরল খনিজ আমদানি করতে বার্ষিক ২০০-৩০০ কোটি টাকা ব্যয় করে। হঠাৎ করে ঘাটতি হলে ভারতের ১,০০০ কোটি টাকা ক্ষতি হতে পারে।
ভারত অবশেষে জেগে উঠছে। ২০২৫ সালের জুন মাসে কেন্দ্র ১ কোটি ১০ লক্ষ টন মজুদ ব্যবহার করার জন্য সমুদ্র সৈকতের বালির খনি নিলামে তুলেছিল। উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আইআরইএল ওড়িশায় নতুন প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র তৈরি করছে। ২০২৫ সালের আগস্টে প্রযুক্তি ভাগাভাগি করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ভারত। স্মার্ট স্টার্টআপগুলি বিরল খনিজের জন্য পুরানো ফোন এবং ল্যাপটপ পুনর্ব্যবহার করার দিকেও নজর দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের চুম্বক তৈরি এবং উপাদানগুলির প্রক্রিয়াকরণের উপর মনোযোগ দেওয়া উচিত।
তাহলে আপনার কী মনে হয়? ভারতের কি বিরল খনিজ শিল্প গড়ে তোলার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো উচিত। এমনকি যদি এতে অর্থ ব্যয় হয় এবং বছরের পর বছর সময় লাগে? আইআরইএল-এর এর জন্য ব্যাপক আপগ্রেড এবং বিনিয়োগ প্রয়োজন। নতুন প্রযুক্তি, দক্ষ কর্মী এবং দ্রুত ছাড়পত্রের প্রয়োজন।
একটা বিষয় নিশ্চিত, এই অদৃশ্য ধাতুগুলিই নির্ধারণ করবে যে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বৈদ্যুতিক গাড়ি চালাবে কি না, উন্নত কারখানায় কাজ করবে কি না এবং সত্যিকারের উন্নত ভারতে বাস করবে কি না।
