আজকাল ওয়েবডেস্ক: ক্রিস্টমাস হোক বা রোজকার ভোরের চা-জলখাবার, অফিসযাত্রীদের টিফিন, রেলস্টেশনের ভিড় থেকে বাজারের ব্যস্ততা, শহর, মফস্বল ও গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে বেকারির খাবার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে। পাউরুটি, কেক, বিস্কুট, টোস্ট, প্যাটিস, এইসব খাবার ছাড়া আধুনিক জীবনের টিফিন প্রায় অকল্পনীয়। কিন্তু এই পরিচিত স্বাদের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে এক কঠিন বাস্তবতা- বেকারি শ্রমিকদের দীর্ঘ শ্রম, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও ক্রমবর্ধমান শোষণ।
দেশের কথা পত্রিকার সাম্প্রতিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে ছোট ও মাঝারি বেকারি কারখানাগুলির ভেতরের চিত্র। অধিকাংশ বেকারিতে শ্রমিক সংখ্যা খুবই কম- গড়পড়তায় ৭ থেকে ৯ জন। দিন ও রাত মিলিয়ে মোট শ্রমিক সংখ্যা ১৪ থেকে ১৮ জনের বেশি নয়। রাতে পাউরুটি ও কেক, দিনে বিস্কুট, লেড়ো, প্যাটিস- এই ধারাবাহিক উৎপাদন চলে প্রায় বিরামহীনভাবে।
রাতের শিফটে কাজ করা শ্রমিকরা সন্ধ্যা ৭টা থেকে পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত কাজ করেন। অনেক সময় ওভারটাইম থাকলে সকাল ৯টাও বেজে যায়। দিনের ও রাতের শ্রমিকদের রোটেশন নেই- বছরের পর বছর একই শ্রমিকদের রাত জেগে কাজ করতে হয়। একটানা ১২ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করা, খোলা আগুন বা শিল্প ওভেনের পাশে থাকা- এটাই তাঁদের দৈনন্দিন বাস্তবতা।
এই কাজের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। দীর্ঘক্ষণ গনগনে তাপমাত্রায় কাজ করার ফলে শ্রমিকদের মধ্যে হিট স্ট্রেস, হিট ক্র্যাম্প, এমনকি হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি দেখা যায়। হৃদস্পন্দন ও শ্বাসপ্রশ্বাসের হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, শরীরে জল শূন্যতা তৈরি হয়। বহু শ্রমিকের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে মেরুদণ্ড, ঘাড়, কাঁধ ও পায়ের তীব্র ব্যথা দেখা দেয়। ময়দা মাখা, ভারী বস্তা তোলা, ট্রে বহনের মতো কাজ এই যন্ত্রণাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত তাপের কারণে বন্ধ্যাত্ব বা ভবিষ্যতে হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়ছে বলে শ্রমিকদের দাবি।
নিরাপত্তার দিক থেকেও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। দ্রুত কাজের চাপে ও সুরক্ষা সরঞ্জামের অভাবে হাত-পা পুড়ে যাওয়া প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। ময়দার ধুলো ও কাঠের উনুনের ধোঁয়া শ্বাসনালিতে প্রবেশ করে ‘বেকারস অ্যাজমা’, দীর্ঘস্থায়ী কাশি ও শ্বাসকষ্ট তৈরি করছে। রাত জেগে কাজ ও তাপজনিত ক্লান্তির ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বাড়ছে।
এই বিপজ্জনক পরিশ্রমের বিনিময়ে মজুরি অত্যন্ত কম। বেকারিগুলিতে ঘণ্টাভিত্তিক মজুরি নেই। ‘মাথা পিছু’ পদ্ধতিতে কাজ হয়- পাউরুটির ক্ষেত্রে প্রতি মাথা ৪০ কেজি ময়দা, কেক ও বিস্কুটের ক্ষেত্রে ২২ কেজি। এর বেশি কাজ হলে তা ওভারটাইম হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু এই ওভারটাইম শ্রমিকের ইচ্ছায় নয়- মালিকের অর্ডার অনুযায়ী বাধ্যতামূলক। একবার ময়দা মাখা হয়ে গেলে কাজ শেষ না করে শ্রমিক বাড়ি ফিরতে পারেন না।
৪০ কেজি পাউরুটির এক মাথার জন্য শ্রমিকরা পান ৩৭৯ টাকা, সঙ্গে ৬ টাকা টিফিন বাবদ। চার-পাঁচ মাথা ওভারটাইম হলে সেই টাকা ভাগ হয়ে যায়। কাজ শিখছেন বা ‘বাচ্চা’ শ্রমিকদের মজুরি মাত্র ২০০ টাকা। ‘সেয়ানা’ শ্রমিকরা ২৫০-৩০০ টাকা পান। যারা পুরো কাজ জানেন, তাঁদের ‘মাথা লোক’ বলা হয়, তাঁদের মধ্যেই একজন ‘মাথা মিস্ত্রি’ হন, যাঁরা উৎপাদন পরিচালনার দায়িত্ব নেন। তাঁদের মজুরি অন্যদের থেকে মাত্র ১০-১৫ টাকা বেশি।
বেশিরভাগ বেকারিতে দৈনিক মজুরি দেওয়া হলেও অনেক সময় তা আটকে রাখা হয়। পিএফ, পেনশন বা সামাজিক সুরক্ষার কোনও ব্যবস্থা নেই। শ্রমিক আন্দোলনের চাপে কিছু কারখানায় সাপ্তাহিক সবেতন ছুটি চালু হয়েছে, আন্দোলনের ফলে মজুরি কিছুটা বাড়লেও সামগ্রিক পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
দীর্ঘদিন ধরে কম মজুরি, ভয়াবহ পরিশ্রম ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কারণে বেকারি শিল্পে ভয়ানক শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। নতুন শিক্ষানবিশরা কাজ শিখতে এসে অল্প সময়েই ছেড়ে চলে যাচ্ছে। পুরনো শ্রমিকরাও নিজেদের সন্তান বা আত্মীয়দের এই পেশায় আনতে চাইছেন না। অনেকেই অন্য পেশায় চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
অথচ বেকারি ব্যবসা মূলত নগদ টাকার ব্যবসা। সারা রাত উৎপাদনের পর সকালেই হকারদের কাছে বিক্রি করে মালিকদের হাতে নগদ টাকা চলে আসে। শ্রমিকদের অভিযোগ, এই নগদ মুনাফার লোভেই মালিকরা মজুরি বাড়াতে রাজি নন, শিল্পে বিনিয়োগও করছেন না। উলটে শ্রমিক ধরে রাখতে কেউ কেউ মাথার ওজন বাড়িয়ে অতিরিক্ত কাজ চাপাচ্ছেন, কেউ ধার দিয়ে শ্রমিক বেঁধে রাখার চেষ্টা করছেন। মজুরি না বাড়ানোর প্রশ্নে মালিকদের মধ্যে এক ধরনের অলিখিত ঐক্য তৈরি হয়েছে।
ফলাফল ভয়াবহ। শ্রমিক সংকটে একের পর এক বেকারি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কোথাও উৎপাদনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে। মালিকরা একে অপরের শ্রমিক ভাঙিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। শ্রমিকদের বক্তব্য, মালিকদের এই লোভ ও স্বল্পদৃষ্টিই বেকারি শিল্পকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
যে শিল্প মধ্যবিত্তের সকালের টিফিন থেকে শ্রমজীবী মানুষের দিনের শুরু পর্যন্ত খাদ্যের জোগান দেয়, সেই শিল্প আজ নিজের শ্রমিকদের বাঁচাতে পারছে না। আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে রুটি বানানো এই মানুষগুলোর জীবন ও জীবিকার প্রশ্নে দ্রুত হস্তক্ষেপ না হলে, বেকারির এই পরিচিত গন্ধ হয়তো একদিন হারিয়েই যাবে।
তথ্য ঋণ: দেশের কথা পত্রিকা
