আজকাল ওয়েবডেস্ক: সোমবার  ১৭ নভেম্বর কার্তিক মাসের সংক্রান্তি। এই দিনে প্রচুর বাঙালির বাড়িতে কার্তিক পুজো করা হলেও মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরে আজকের দিনে বিভিন্ন পাড়া এবং মন্দিরে পূজিত হন  হনুমান, শিব, ভৈরব এবং পার্বতীর সঙ্গে বাবা কৈলাস।

শহরের বিভিন্ন এলাকার পুজো কমিটির সদস্যরা তাদের পুজোকে অন্য পুজোর থেকে আলাদা করার জন্য শিব ঠাকুরের বিভিন্ন নামও দিয়েছেন।

শহরের কোথাও ভৈরবের নামকরণ করা হয়েছে 'ডাব বাবা', কোথাও 'বোল্ডার বাবা', কোথাও আবার 'হটাৎ বাবা', 'বট বাবা', 'নিম বাবা'-র মতো হরেক নাম।

তবে বহরমপুর শহরের সব থেকে প্রাচীন শিব পুজোগুলোর মধ্যে অন্যতম  খাগড়া ভৈরবতলা এলাকার 'ভৈরব বাবা'র পুজো এবং সৈদাবাদ এলাকার  'নিম বাবা'র পুজো।

ভৈরবতলার মন্ডপে প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতার শিব মূর্তির পুজো করা হয়। অন্যদিকে, সৈদাবাদ নিমতলা পাড়া ভৈরব পুজো কমিটির মন্দিরে ভগবান শিবের ভৈরব মূর্তিকে তাঁর বাহন ষাঁড়ের উপর বসে থাকতে দেখতে পাওয়া যায়। 

মুর্শিদাবাদ জেলার প্রচুর মানুষের বিশ্বাস সৈদাবাদ নিমতলা পাড়া বাবা ভৈরবের কাছে কোনও ভক্ত কিছু মানত করলে ভগবান ভক্তের সেই ইচ্ছা পূরণ করেন।

তাই এই পুজোতে বাবা ভৈরবের মূর্তি নির্মাণের খরচ বহন করার জন্য প্রত্যেক বছর বহু লোক মানত করে রাখেন। পুজো কমিটির ট্রাস্টি বোর্ডের অন্যতম সদস্য অরূপ চক্রবর্তী বলেন, ''নিম বাবা ভৈরবের পুজোর মানত আপাতত ২০৮৩ সাল পর্যন্ত নেওয়া রয়েছে। এরপর এবছরও বেশ কিছু লোক বাবা ভৈরবের পুজোর খরচ বহন করার জন্য মানত করবেন বলে আমাদের অনুমান। সেক্ষেত্রে তাঁরা ২০৮৪ সাল বা তার পরের কোনও একটি বছর পুজোর ব্যয়ভার বহন করতে পারবেন।''

পুজো কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, এ বছর খাগড়া মোহন রায় পাড়া এলাকার বাসিন্দা জনৈক দীপু ভট্টাচার্য পুজোর যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করবেন। সূত্রের খবর, তাঁর  পরিবার প্রায় ৩০-৪০ বছর আগে এই পুজোর ব্যয়ভার বহন করার মানত করেছিলেন। অরূপ বাবু বলেন,''সৈদাবাদ এলাকায় 'নিম বাবা' ভৈরবের পুজো ঠিক কত বছর আগে শুরু করা হয়েছিল তা কেউ বলতে পারেন না। তবে অনেকেরই অনুমান, এই পুজোর বয়স ২০০ বছরের বেশি। এখানে ভৈরবের কাছে কোনও কিছু মানত করলে ভগবান শিব ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। তাই অনেক ভক্তই দেবতার মূর্তি নির্মাণ-সহ পুরোহিতের দক্ষিণা এবং প্রথম পুজোর পুরো ব্যয়ভার বহন করার মানত করে যান।''

পুজো কমিটির তরফ থেকে মানত রাখা ব্যক্তিদের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে মূলত খাগড়া এবং সৈদাবাদ এলাকার মানুষেরাই ঠাকুরের পুজোর ব্যয়ভার বহনের মানত করলেও নদিয়া, লালবাগের মতো এলাকা থেকেও কিছু ব্যক্তি পুজোর খরচ বহনের জন্য নিজেদের নাম নথিভুক্ত করে রেখেছেন।

কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০৫০ সালে নদীয়া জেলার বাসিন্দা জনৈক সাধনা হাইতের এই পুজোর ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব পড়েছে। ২০৮৩ সালে বহরমপুরের নেতাজি রোড এলাকার বাসিন্দা দিপালী দত্তের উপর এই পুজোর ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব রয়েছে। 

পুজো কমিটির সদস্যরা জানান, অত্যন্ত জাগ্রত এই পুজোর প্রতিমা নির্মাণ সৈদাবাদ এলাকার দাস পরিবারের সদস্যরা তৈরি করেন। আগে এই ঠাকুর তৈরি করতেন বিমল দাস। বর্তমানে তাঁর ছেলে বাবন দাস নিম বাবার মূর্তি তৈরি করেন। 

পুজো কমিটির সদস্যরা আরও জানান, প্রত্যেক বছর নিম বাবার মূর্তি নিরঞ্জন হলেও তাঁর পাটাতনটি রেখে দেওয়া হয় এবং তার উপরেই প্রত্যেক বছর নতুন করে মূর্তি তৈরি করা হয়। 

নিম বাবার প্রতি ভক্তদের অশেষ বিশ্বাসের কারণে প্রত্যেক বছর বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু ভক্ত এসে সোনা এবং রুপোর ত্রিশূল, চাঁদ-সহ নানা রকম অলংকার দিয়ে থাকেন বাবার চরণে। 

পুজো কমিটির সদস্যরা জানান, নিম বাবার কয়েক কেজির সোনা এবং রুপোর অলঙ্কার রয়েছে।  পুজোর দিন ভক্তদের দেওয়া অলংকারের মধ্যে থেকে বাছাই করা কিছু অলংকার দিয়ে মূর্তিকে সাজানো হয়।

এর পাশাপাশি পুজোর ব্যয়ভার বহন করার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড তৈরি করা হয়েছে। তাঁদের অধীনে এই নিম বাবার নামে শহরের বিভিন্ন জায়গায় কিছু জায়গা জমি কেনা এবং বাড়িও তৈরি করা হয়েছে।

সেখান থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে পুজোর একটি বড় অংশের ব্যয়ভার বহন করা হয়। অরূপ বাবু বলেন, "বর্তমানে নিম বাবার একটি মন্দিরও তৈরি করা হয়েছে। আমাদের মন্ডপে কার্তিক মাসের সংক্রান্তির দিন বৈষ্ণব মতে নিম বাবার পুজো করা হয়। কার্তিক সংক্রান্তির দিন থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রায় সাত দিন দু'বেলা করে বাবা ভৈরবের পুজো করা হয়। পুজোর সময় দেবতার উদ্দেশ্যে আমরা পায়েস, লুচি-সহ নানা ধরনের ফলপ্রসাদ ভোগ হিসেবে নিবেদন করে থাকি। এছাড়াও পুজোর অঙ্গ হিসেবে একদিন প্রায় দশ হাজার মানুষকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়।''

তিনি আরও বলেন, ''কয়েক বছর আগেও বাঁশের তৈরি করা পালকিতে চেপে অথবা ভ্যানে চাপিয়ে প্রতিমাকে শহর পরিক্রমা করানোর পর ভাগীরথীর বক্ষে নিরঞ্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হত। শোভাযাত্রা-সহ আমাদের প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় আলোকসজ্জা দেখতে এবং নিম বাবার আশীর্বাদ নেওয়ার জন্য ওই দিন  শহরের হাজার হাজার মানুষ পথের দু'ধারে জড়ো হয়ে থাকেন।''

অরূপ বাবু বলেন, ''তবে সকলের সুবিধার জন্য বর্তমানে নিম বাবার নিরঞ্জনের জন্য বিশেষ একটি ট্রলি তৈরি করা হয়েছে। তার উপরে বাবা ভৈরবকে বসিয়ে শহর পরিক্রমা  করানো হয়। এরপর ভাগীরথী বক্ষে তাঁকে নিরঞ্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।''