মিল্টন সেন,হুগলি,১২ জুলাই: এক অভাবনীয় ঘটনার সাক্ষী রইল পশ্চিমবঙ্গ। দুই বছর আগে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এক ৭০ বছরের বৃদ্ধ অবশেষে স্মৃতি ফিরে পেয়ে বাড়ি ফিরলেন। নেপথ্যে ছিল হ্যাম রেডিওর সদস্যদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা। এই ঘটনা ঘিরে সম্প্রতি চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে৷
ঘটনাটি শুরু হয়েছিল এক শীতল ডিসেম্বরের রাতে। ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা জিটি রোড ধরে একমনে হেঁটে যাচ্ছিলেন বছর সত্তরের প্রসূন ঝা। কোনও নির্দিষ্ট গন্তব্য ছিল না, স্মৃতি ছিল ঝাপসা। তিনি এলজাইমার রোগে আক্রান্ত ছিলেন। খবর অনুযায়ী একদিন হঠাৎই দিশেহারা হয়ে রাস্তায় পড়ে যান তিনি। জানা যায় একটি গাড়ির চাকা তাঁর পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় তিনি পড়ে ছিলেন রাস্তার পাশে। ঠিক সেই সময় তাঁকে দেখতে পান চুঁচুড়া ট্রাফিক গার্ডের পুলিশ কর্মী রাজু দেবনাথ। তৎক্ষণাৎ তাঁকে উদ্ধার করে ভর্তি করা হয় শ্রীরামপুরের ওয়ালস হাসপাতালে। কিন্তু তখন বৃদ্ধ নিজের নাম, ঠিকানা কিছুই বলতে পারছিলেন না বলে জানায় পুলিশ।
দীর্ঘ চিকিৎসার পর ধীরে ধীরে সুস্থ হতে শুরু করেন তিনি। হাসপাতালের অতিরিক্ত সুপার ড: বাসুদেব জোয়ারদার বৃদ্ধের পরিচয় জানার উদ্যোগ নেন। এরপর প্রয়োজন বুঝে যোগাযোগ করেন হ্যাম রেডিও ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিও ক্লাবের সঙ্গে।
এরপর হ্যাম রেডিওর সদস্যরা তৎপরতার সঙ্গে অনুসন্ধান শুরু করেন। আচমকা একদিন প্রসূনবাবুর মনে পড়ে যায় 'বেগুসরাই'-এর কথা। তিনি বলেন, তাঁর বাড়ি বিহারের বেগুসরাই জেলার চালকিচক গ্রামে। এরপর সেখানে গিয়ে খোঁজ চালান হ্যাম রেডিওর সদস্যরা। দোকানদার থেকে গ্রামপ্রধান – কেউই তাঁকে চিনতে পারেননি। এমনকি তিনি যে একজন সমাজসেবীর নাম বলেন, তিনি নিজেও বৃদ্ধকে চিনতে অস্বীকার করেন।
হ্যাম রেডিওর সদস্যরা একাধিক তল্লাশির পরও বৃদ্ধের বাড়ি খুঁজে পাননা৷ এই অবস্থায় সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যেতে গিয়েই, হঠাৎ উদ্ধার আসে দুর্গাপুর থেকে। স্টিল প্রজেক্ট এলাকার কাছে এক ব্যক্তি তাঁর ছবি দেখে চিনে ফেলেন। খবর মাধ্যমে জানা গিয়েছে তিনি বলরাম ঝা। দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টের কর্মী। তিনি জানান, প্রসূন ঝা তাঁর ছোট ভাই। তাঁর ভাই এলজাইমারে আক্রান্ত এবং বছর দুয়েক আগে হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন বলে তিনি জানান। প্রসূনবাবু ভাইয়ের সঙ্গেই থাকতেন।
আরও পড়ুনঃ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ফের ছাত্রী যৌন নির্যাতনের অভিযোগ, বেআইনি তদন্তের অভিযোগ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সহ
তদন্তে জানা গিয়েছে, বাবার সঙ্গে ছোটবেলায় ট্রেনে সফরের সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়েন তাঁরা। বেগুসরাই এলাকাতেই ঘটনাটি ঘটেছিল বলে জানা গিয়েছে। প্রাথমিকভাবে অনুমান করা গিয়েছে সেই পুরনো স্মৃতি বিভ্রান্ত করে দেয় তাঁকে। সেই কারণেই বারবার বেগুসরাইয়ের নাম করছিলেন। যাঁর নাম প্রসূন ঝা করেছিলেন, সম্ভবত সেই সময় তাঁদের কোনোভাবে সাহায্য করেছিলেন সেই ব্যক্তি।
সকল জল্পনার অবসান ঘটিয়ে শনিবার অবশেষে নিজের বাড়িতে ফেরেন প্রসূন ঝা। তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও হ্যাম রেডিওর সদস্যরা। সঙ্গে ছিল স্থানীয় পুলিশ। মানবিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রইল এই ঘটনা। একজন নিখোঁজ বৃদ্ধ, যাঁর কাছে নিজের পরিচয়ও ছিল এক রহস্য, সেই মানুষকে পরিবারে ফিরিয়ে দিল একঝাঁক অদম্য মানুষের প্রচেষ্টা। বিশেষ করে হ্যাম রেডিও ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিও ক্লাব, হাসপাতালের চিকিৎসক, পুলিশ এবং দুর্গাপুরের স্থানীয় মানুষের সহানুভূতি ও উদ্যোগ।
ছবি : পার্থ রাহা
