আজকাল ওয়েবডেস্ক:  কল্পনা করুন এমন এক সাপ, যার আকার এতটাই বিশাল যে সে একটি দরজাকেও আটকে দিতে পারে। বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি আবিষ্কার করেছেন টাইটানোবোয়া সেরেহোনেনসিস—পৃথিবীর ইতিহাসে জানা সবচেয়ে বড় সাপ। প্রায় ৫৮ মিলিয়ন বছর আগে, ডাইনোসরের বিলুপ্তির কিছুদিন পরই এই দৈত্যাকার সাপ দক্ষিণ আমেরিকার রেইনফরেস্টে রাজত্ব করত। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জার্নাল নেচার–এ প্রকাশিত এই আবিষ্কার প্রাগৈতিহাসিক জীবনের নতুন জানালা খুলে দিয়েছে।


টাইটানোবোয়ার দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ ফুট পর্যন্ত এবং প্রস্থ তিন ফুট। ওজন ছিল এক টনেরও বেশি। অর্থাৎ আজকের দিনের সবচেয়ে বড় এনাকোন্ডা বা বোয়া সাপের তুলনায় অনেক গুণ বৃহৎ। তার বিশাল শরীর ছিল শিকারকে পেঁচিয়ে চূর্ণ করার জন্য উপযুক্ত। সে সময়ের বাস্তুতন্ত্রে এটি ছিল সর্বোচ্চ শিকারি।

আরও পড়ুন: ভারতের বর্ষার সঙ্গে এল নিনোর সম্পর্ক কী, নতুন গবেষণায় চমকপ্রদ তথ্য


ফসিল বা জীবাশ্ম পাওয়া গেছে কলোম্বিয়ার উত্তরাঞ্চলের সেরেহোন কয়লাখনি থেকে। এই খনিটি প্রাচীন রেইনফরেস্টের জীববৈচিত্র্যকে ধরে রেখেছিল, যা বিজ্ঞানীদেরকে পৃথিবীর অতীতের বিরল প্রমাণ দিয়েছে। এখানে শুধু টাইটানোবোয়া নয়, পাওয়া গেছে বিশালাকার কচ্ছপ এবং প্রাচীন কুমিরজাতীয় প্রাণীর জীবাশ্মও—যারা সম্ভবত এই দৈত্যাকার সাপের শিকার ছিল।


ফ্লোরিডা মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রির কশেরুকা জীবাশ্মবিদ জোনাথন ব্লখ এবং পানামার স্মিথসোনিয়ান ট্রপিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্যালিওবোটানিস্ট কার্লোস জারামিলো এই অভিযানের নেতৃত্ব দেন। টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবাশ্মবিদ জেসন হেড বলেছিলেন, “যদি এই সাপ আমার অফিসে ঢুকত, তবে দরজা দিয়ে ঢোকার আগে শরীর চেপে ধরতে হতো।”


কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও বিবর্তনবিদ্যার অধ্যাপক হ্যারি ডব্লিউ. গ্রিন উল্লেখ করেন, টাইটানোবোয়ার আবিষ্কার ট্রপিক্যাল অঞ্চলের প্রাগৈতিহাসিক জীববৈচিত্র্য বোঝার ক্ষেত্রে অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ। ঠান্ডা-রক্তের প্রাণীর আকার সরাসরি নির্ভর করে পরিবেশের তাপমাত্রার উপর। গবেষকরা হিসাব করেছেন যে টাইটানোবোয়া যখন বেঁচে ছিল, তখন নিরক্ষীয় দক্ষিণ আমেরিকার গড় তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৯১ ডিগ্রি ফারেনহাইট, অর্থাৎ আজকের চেয়ে প্রায় ১০ ডিগ্রি বেশি। এই কারণেই সাপ এত বিশাল আকার ধারণ করতে পেরেছিল।


মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক স্টিফেন ডিকারবি বলেন, এই আবিষ্কার শুধু একটি প্রাণীর গল্প নয়, বরং সেই সময়কার পুরো বাস্তুতন্ত্র বোঝার গুরুত্বপূর্ণ সূত্র।


তাহলে আজ কেন এমন বিশাল সাপ নেই? বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তন অতীতের ধীর গতির উষ্ণায়নের মতো নয়। দ্রুতগতির উষ্ণতা, বাসস্থানের ধ্বংস, এবং মানুষের হস্তক্ষেপ মিলিয়ে এধরনের প্রাণীর অস্তিত্ব অসম্ভব হয়ে গেছে।


টাইটানোবোয়া ছিল ডাইনোসরের বিলুপ্তির পর পৃথিবীর প্রথম রেইনফরেস্টের শাসক। সে সময় বিশাল কচ্ছপ এবং বিলুপ্ত কুমিরজাতীয় প্রাণীর সঙ্গে সে সহাবস্থান করত। গবেষকরা আধুনিক সাপের কশেরুকার আকার ও শরীরের ওজনের তুলনা করে টাইটানোবোয়ার মাপ নির্ধারণ করেছেন।
জোনাথন ব্লখ একে বর্ণনা করেছেন “ডাইনোসর বিলুপ্তির পরপরের পৃথিবী দেখার একটি জানালা” হিসেবে। এই গবেষণা প্রমাণ করে জলবায়ু ও সরীসৃপের আকারের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যদিও টাইটানোবোয়া আজ আর নেই, তার অস্তিত্ব আমাদের মনে করিয়ে দেয়—পৃথিবীর প্রাচীন জলবায়ু কেমনভাবে জীবনের ধরণ নির্ধারণ করেছিল। এই গবেষণা শুধু অতীতের রহস্য উদঘাটন করেনি, বরং পৃথিবীর গভীর ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যোগ করেছে।