আজকাল ওয়েবডেস্ক: জলের সঙ্গে মাছের যেমন সম্পর্ক, ছেলেবেলা থেকে বহরমপুরের গান্ধী কলোনী এলাকার বাসিন্দা বিশ্বনাথ অধিকারীরও নদী-সমুদ্রের সঙ্গে সম্পর্ক অনেকটা তেমনই। 

সারা বছর ভাগীরথী নদীর ঠান্ডা জলে ঘন্টার পর ঘন্টা সাঁতার কেটে নিজেকে  দূরপাল্লার সাঁতারু হিসেবে তৈরি করেছেন। 

আর তারই ফলশ্রুতি হিসেবে মুর্শিদাবাদ জেলায় অনুষ্ঠিত বিশ্বের দীর্ঘতম সাঁতার প্রতিযোগিতায় পরপর চারবার তৃতীয় স্থান এবং একবার দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছেন বহরমপুর সুইমিং ক্লাবের সদস্য বিশ্বনাথ। 

এর পাশাপাশি মালয়েশিয়া, মিশর এবং দুবাইতে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পদক জয় করেছেন বহরমপুরের বিশ্বনাথ। এখন তাঁর স্বপ্ন 'সাঁতারের মাউন্ট এভারেস্ট'ইংলিশ চ্যানেল জয় করা। 

ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই জলপথ পাড়ি দেওয়া কোনও সাধারণ চ্যালেঞ্জ নয়।  ঠান্ডা জল,  জেলি ফিশের আক্রমণ, প্রবল স্রোত -সব মিলিয়ে এক অসম্ভব প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি করে সাঁতারুর জন্য। 

বাংলার একাধিক সাঁতারু ইংলিশ চ্যানেল জয় করতে পারলেও বিশ্বনাথের মতো প্রতিভাবান একজন সাঁতারু শুধুমাত্র অর্থের কারণে ইংলিশ চ্যানেলের জলে নামতে পারছেন না। 

বর্তমানে বহরমপুরের একটি বেসরকারি স্কুলে এবং বহরমপুরের একটি সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন বিশ্বনাথ। 

বাড়িতে রয়েছেন বৃদ্ধ বাবা-মা। শত আর্থিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ছোটবেলা থেকেই বিশ্বনাথ  বড় সাঁতারু হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। 

আর সেই লক্ষ্যে ছোটবেলা থেকে বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভাগীরথী বক্ষে ঘন্টার পর ঘন্টা সাঁতার কেটে নিজেকে তৈরি করেছেন 'লং ডিসট্যান্স' সাঁতারু হিসেবে। 

বিশ্বনাথ বলেন, ''২০১৫ -১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বের দীর্ঘতম ৮১ কিলোমিটার সাঁতার প্রতিযোগিতায় আমি পরপর চারবার তৃতীয় স্থান এবং ২০১৯ সালে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করি। কোভিডের কারণে এর পরের বছর সাঁতার প্রতিযোগিতা বন্ধ থাকায়  অংশগ্রহণ করতে পারিনি।  ২০২১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করি। বহু জায়গায় দরবারের পর অবশেষে ২০২৪ সালে আমি প্রথমবার দেশের হয়ে মালয়েশিয়ায় একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়  সাঁতার কাটার সুযোগ পাই। কাপাস দ্বীপ থেকে মারাং পর্যন্ত  সমুদ্র বক্ষে প্রায় সাড়ে ৬ নটিক্যাল মাইল  প্রতিযোগিতায় ২১টি দেশের মধ্যে আমি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করি। এরপর আমি মেক্সিকোতে একটি আন্তর্জাতিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় ডাক পেয়েও অর্থের অভাবে সেখানে যেতে পারিনি।"
 
এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বনাথ  মিশরের এল গোয়ানা শহরে দেশের হয়ে একটি আন্তর্জাতিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। ৩২টি দেশের প্রতিযোগিতায় বিশ্বনাথ ভারতের হয়ে প্রথম স্থান দখল করেন।

 এর জন্য তিনি দুবাইতে 'ওয়ার্ল্ড ফাইনাল সুইমিং চ্যাম্পিয়নশিপে' অংশগ্রহণ করার ডাক পান। 'ওয়ার্ল্ড ওপেন ওয়াটার সুইমিং অ্যাসোসিয়েশন' আয়োজিত  এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শতাধিক সাঁতারু এবং অলিম্পিয়ান অংশগ্রহণ করেছিলেন। 

বিশ্বনাথ জানান ,"দুবাইতে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে যাওয়ার খরচ অত্যন্ত বেশি ছিল। বহরমপুরের দু'টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় আমি সেখানে কোনও রকমে যেতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমার কোচকে সেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ওই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের সর্বোচ্চ স্তরের সাঁতারুদের সঙ্গে সাঁতার কাটতে গিয়ে আমি নিজের প্রস্তুতির অভাব বুঝতে পেরেছিলাম। তবে ওই প্রতিযোগিতা থেকে আমি ভবিষ্যতে কীভাবে তৈরি হব তার শিক্ষা নিয়ে ফিরেছি।"
 
বিশ্বনাথ বলেন,"এখন আমার স্বপ্ন ইংলিশ চ্যানেল জয় করা। এই  চ্যানেল অতিক্রম করার খরচ প্রায় ১৮ লক্ষ টাকা। তার মধ্যে প্রায় ৪ লক্ষ টাকা অগ্রিম দিতে হয় আয়োজক সংস্থাকে। এরপর ৬-৯ মাস ব্রিটিশ সংস্থার অধীনে সেখানে থেকে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। তার জন্য বিপুল খরচ রয়েছে।"
 
কিন্তু বহরমপুরের দু'জায়গায় সাঁতার শিখিয়ে যে আয় হয় তা দিয়ে বিশ্বনাথের পক্ষে এই স্বপ্নপূরণ করা সম্ভব নয়। সেই কারণে বিভিন্ন জায়গায় স্পন্সরশিপের জন্য দরবার করেছেন। 

গলায় কিছুটা অভিমানের সুর নিয়ে বিশ্বনাথ বলেন,"নিজের ইংলিশ চ্যানেল জয়ের স্বপ্নপূরণ করার জন্য বহু রাজনীতিবিদের কাছে গিয়ে হাত পেতেছি। যদিও বেশিরভাগ রাজনীতিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছু দেননি। আমার সাঁতার জীবনের অতীত ইতিহাস দেখেও কোনও সংস্থা আমাকে স্পনসর করে পিছিয়ে পড়া এই জেলায় সাঁতারের মতো একটি খেলার অগ্রগতির জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেনি।"
 
তবে এখনও আশা ছাড়েননি বিশ্বনাথ।  তিনি আশাবাদী খুব দ্রুত কেউ তাঁর স্বপ্ন পূরণের জন্য আর্থিক সাহায্যের ডালি নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেন। বিশ্বনাথ বলেন, "এখন যদি আমি টাকা জমাতে পারি তাহলে হয়তো ২০২৭ সালে আমার ইংলিশ চ্যানেল জয়ের স্বপ্নপূরণ হবে।"

তবে বিশ্বনাথের সাঁতার জীবনের সাফল্যের কাহিনি শোনার পর তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের বহরমপুর মুর্শিদাবাদ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি অপূর্ব সরকার। তিনি বলেন, "ছেলেটি যদি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাহলে আমি আমার সাধ্যমতো সাহায্য তাঁকে করব।"