জয়ন্ত ঘোষাল: আরজি কর নৃশংস ধর্ষণের ঘটনার তীব্র নিন্দা করছে গোটা সমাজ, গোটা দেশ। এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মূলত প্রবাসী বাঙালি ভারতীয়রা এই ঘটনার নিন্দা করে রাস্তাঘাটে মিছিল করছেন। একটাই স্লোগান উঠেছে— 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস'। এই ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি। এবং এ ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে ধরা পড়ছে, পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিষেবার বেশ কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি। সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে দুষ্ট চক্রের। পুলিশ তদন্ত করছে। সিবিআই তদন্ত করছে। সুপ্রিম কোর্ট নিজে থেকে এ ঘটনার দায়িত্ব নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করল। এই সবটাই ধর্ষণের ভয়ঙ্কর ঘটনার একটি স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক দিক। আন্দোলন শুরু হয়েছে বিভিন্ন পেশার মানুষদের পক্ষ থেকেও। এক কথায় বলা যেতে পারে যে, এটা হল স্বতঃস্ফূর্ত অর্গানিক একটা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। 

 

এটা হল ধর্ষণের ঘটনাটির একটি দিক। কিন্তু ধর্ষণ কখনও বিজেপির ধর্ষণ, তৃণমূলের ধর্ষণ, কংগ্রেসের ধর্ষণ, সিপিএম-এর ধর্ষণ— এভাবে তো কোনও রাজনৈতিক দলের ধর্ষণ হয় না। ধর্ষণকারী সমাজের আততায়ী বলে পরিচিত হয়। তাদের ফাঁসি হওয়া উচিত— এমনটাই মনে করছে এই মুহূর্তে সমাজের বহু নাগরিক। এই ধর্ষণ এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার ত্রুটিবিচ্যুতিকে মূলধন করে বিজেপি যেভাবে রাজনীতি করতে শুরু করেছে, যেভাবে এটিকে মূলধন করে মমতা ব্যানার্জিকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনকি রাজ্যপাল দিল্লি গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করছেন এবং বিজেপির একটা অংশ অবিলম্বে পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার চেষ্টা করছে। এই সবই হল দিল্লির শাসক দলের মমতা বিরোধী রাজনীতি। ধর্ষণের বিচার করতে গিয়ে ‘মমতা হটাও’ অভিযানকে অগ্রাধিকার দেওয়া— এটা কিন্তু আর যাই হোক, ধর্ষণের প্রতিবাদে সুষ্ঠু পদক্ষেপ নয়। 

 

মমতা ব্যানার্জিকে আমার পছন্দ নাও হতে পারে। মমতা ব্যানার্জি তথা তৃণমূল কংগ্রেসের মতাদর্শ আমার অপছন্দ হতে পারে। আমি সিপিএম হতে পারি। আমি বিজেপি হতে পারি। আমি রাজ্য কংগ্রেসের সমর্থক হতে পারি। সব ভাল, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের এই ঘটনাটিকে মূলধন করে নির্বাচিত একটি সরকারকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা, মমতা ব্যানার্জিকে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা, সেই রাজনীতিটাকেও কিন্তু একই সঙ্গে নিন্দা করতে হবে। 

 

মমতা ব্যানার্জির সমর্থক হওয়ার দরকার নেই। তবে ধর্ষণের মতো একটা সামাজিক ব্যাধিকে যদি নির্মূল করতে হয়, তাহলে কিন্তু দলমত নির্বিশেষে কোথাও একটা ঐক্যমত্যের প্রস্তুতি প্রয়োজন। কোথাও একটা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের রাস্তা খোঁজা প্রয়োজন। পুলিশের ত্রুটি, হাসপাতালের কর্মীদের ত্রুটি, দুষ্টচক্রের দুর্বৃত্তি, সবকিছু মেনে নিয়েও বলা যায়, দীর্ঘদিন ধরে জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্মঘট, রোগীদের চিকিৎসা না পাওয়া, সেগুলি সম্পর্কেও হাইকোর্টও বলেছে, আলাপ-আলোচনা করে এগুলোর মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন। 

 

সু্প্রিম কোর্ট বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছে। দেরিতে এফআইআর হয়েছে, পুলিশের নিরাপত্তার জায়গায় সিআরপিএফ-কে দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সন্দীপের ভূমিকা নিয়েও সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন করেছে। সেগুলোর বিচার হোক। মমতা ব্যানার্জি নিজেই তো প্রথম থেকে সিবিআই তদন্তের কথা বলেছেন। সেই কথা ধর্ষিতা কন্যাটির মা-বাবাও বলেছেন যে, মমতা ব্যানার্জিই প্রথম সিবিআই তদন্তের কথা বলেছেন। সুতরাং, এক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জি কী কী করেছেন, কী কী করেননি, তার বিচার করার আগে এটা বুঝতে হবে যে, মমতা ব্যানার্জি কিন্তু সমস্যাটা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। 

 

আর এই পরিস্থিতিতে মমতা ব্যানার্জিকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বাংলাদেশের স্টাইলে মিথ্যা তথ্যের বন্যা বইয়ে দেওয়া এবং এক ধরণের তথ্য-সন্ত্রাস তৈরি করা, সেটাও কিন্তু সমর্থনযোগ্য নয়। হতে পারে, এই তথ্য-সন্ত্রাসের মধ্যে ভুয়ো খবরের বন্যায় কলকাতা পুলিশের একটা নিজার্ক রিয়্যাকশন দেখা গেছে। হতে পারে, কলকাতা পুলিশ ধরে আনতে বলার জায়গায় বেধে আনতে চেষ্টা করেছে সমস্যাতে বিচলিত হয়ে। কিন্তু তাই বলে অসত্য প্রচারকেও কি সমর্থন করা যায় শুধুমাত্র অন্ধ মমতা বিরোধিতার জন্য? 

 

তাই আমি আশা করব, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ- তারা বিচার-বুদ্ধি দিয়ে, যুক্তি দিয়ে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করুন। আমরা সবাই মিলে সেই অত্যাচারিত ধর্ষিতা কন্যাটির যারা ধর্ষক, তাদের কঠোরতম শাস্তি যেরকম চাইছি। ঠিক সেইভাবে ভাবছি, যাতে আমাদের এই সোনার বাংলাতে যেন নৈরাজ্য এসে না পড়ে। এক ধরণের ভিড়তন্ত্র যাতে দখল না নিতে পারে আমাদের জীবনযাত্রার চাবিকাঠি নিয়ন্ত্রণে।