আজকাল ওয়েবডেস্ক: মার্কিন রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক স্থাপন করলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত সমাজতন্ত্রী জোহরান ক্বামি মামদানি। মঙ্গলবার রাতে বিপুল সমর্থকদের সামনে বিজয় ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি ঘোষণা করেন, “আজ নিউইয়র্কে এক রাজনৈতিক রাজবংশের পতন ঘটল।” ৩৪ বছর বয়সি মামদানি নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়র এবং গত একশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।

তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যান্ড্রু কুয়োমো এবং রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া-কে পরাজিত করে এই ঐতিহাসিক জয় অর্জন করেন। মামদানি বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস-এর স্থলাভিষিক্ত হবেন, যিনি সেপ্টেম্বর মাসে পুনর্নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান, তবে ভোটের ব্যালটে তাঁর নাম রয়ে গিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধনীতম শহর নিউইয়র্কে এবারের মেয়র নির্বাচন ঘিরে চলছে নজিরবিহীন উত্তেজনা। সোমবার, ৩ নভেম্বর, প্রাথমিক ভোটদান পর্বের শেষ দিনে রেকর্ড সংখ্যক ভোটার ভোটকেন্দ্রে হাজির হন। নিউইয়র্ক সিটি বোর্ড অব ইলেকশনসের তথ্য অনুযায়ী, গত নয় দিনে মোট ৭,৩৫,৩১৭ জন ভোটার আগাম ভোট দিয়েছেন—যা ২০২১ সালের মেয়র নির্বাচনের তুলনায় চারগুণেরও বেশি।

এই নির্বাচনের বিশেষত্ব হলো, এবারে শহরের মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন একজন স্বঘোষিত গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী—৩৪ বছর বয়সি জোহরান ক্বামি মামদানি, যিনি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী। উগান্ডায় জন্ম নেওয়া ও কুইন্সে বড় হওয়া মামদানি নিউইয়র্কে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন তাঁর সমাজতান্ত্রিক চিন্তা, উচ্চভাড়ার বিরোধিতা, কর্পোরেট কর বাড়ানো, ও সৃজনশীল প্রচারের জন্য।

মামদানির নির্বাচনী ইশতেহারে রয়েছে তিনটি প্রধান প্রতিশ্রুতি—
 শহরের ২৪ লক্ষ ভাড়াটে পরিবার-এর জন্য ভাড়া স্থগিত রাখা,
 নিউইয়র্কের বাস সার্ভিস বিনামূল্যে করা,
এবং সরকারি পরিচালিত গ্রোসারি দোকান খোলা, যাতে খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকে।

গত ২৪ জুনের ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারিতে মামদানি ১২ পয়েন্ট ব্যবধানে পরাজিত করেন বিতর্কিত প্রাক্তন গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমোকে। কিন্তু তাতেও কুয়োমো হার মানেননি; বরং তিনি এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন—ডেমোক্র্যাট পার্টির ভিতরে নিজের প্রতিষ্ঠিত ঘাঁটির ওপর ভর করেই।

প্রচারের পেছনে অর্থের জোয়ার এনেছেন মার্কিন বিলিয়নিয়াররা। তথাকথিত স্বাধীন “সুপার প্যাক” Fix the City-তে কুয়োমোর সমর্থনে প্রায় ২৫ মিলিয়ন ডলার ঢেলেছে কর্পোরেট মহল। এর মধ্যে রয়েছেন ধনকুবের বিল অ্যাকম্যান (১ মিলিয়ন ডলার), মাইকেল ব্লুমবার্গ (১.৫ মিলিয়ন ডলার), ও এয়ারবিএনবি সহ-প্রতিষ্ঠাতা জো গেবিয়া (১ মিলিয়ন ডলার)।

বিরোধীরা বলছেন, এই অর্থসাহায্য প্রমাণ করছে যে কুয়োমো বিলিয়নিয়ার লবির হাতিয়ার হয়ে উঠেছেন। মামদানি নিজেও বলেছেন, “আমার প্রচার চালাচ্ছে নিউইয়র্কের মানুষ, আর কুয়োমোর প্রচার চালাচ্ছে সেই সব কোটিপতি যারা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ওয়াশিংটনে বসিয়েছিল।”

নির্বাচনের আগের দিন ইলন মাস্ক তাঁর নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ পোস্ট করে কুয়োমোর পক্ষে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি লিখেছেন, “মনে রেখো, কার্টিসকে ভোট দেওয়া মানে মামদুমিকে জেতানো।” অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, “একজন খারাপ ডেমোক্র্যাট আর একজন কমিউনিস্টের মধ্যে আমি সবসময় খারাপ ডেমোক্র্যাটকেই বেছে নেব।”

৩ ও ৪ নভেম্বর ট্রাম্প নিজের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম “ট্রুথ সোশ্যাল”-এ আরও এক ধাপ এগিয়ে মামদানিকে সরাসরি আক্রমণ করেন। তিনি লিখেছেন, “মামদানি জিতলে নিউইয়র্ক সিটি যেন ন্যূনতম ফেডারেল সাহায্যও না পায়, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত থাকব।” মামদানি এবং তাঁর টিমকে নির্বাচনী প্রচারে একাধিকবার ইসলামবিরোধী ও বর্ণবাদী আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে। রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ এমনকি একটি ভুয়ো ব্যালট পোস্ট করেন, যেখানে মামদানিকে “একজন আসল কমিউনিস্ট জিহাদিস্ট” বলে উপহাস করা হয়।


এই নির্বাচন এখন শুধু মেয়র নির্বাচনের সীমা ছাড়িয়ে দাঁড়িয়েছে এক বৃহত্তর রাজনৈতিক সংঘর্ষে—বিলিয়নিয়ার পুঁজির রাজনীতি বনাম জনমানুষের সমাজতন্ত্র। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই জানা যাবে, নিউইয়র্কবাসী কি তাঁদের শহরকে সমাজতান্ত্রিক পরীক্ষার পথে নিয়ে যেতে চান, নাকি পুরনো ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর হাতেই ভবিষ্যৎ তুলে দেবেন। একজন ভোটারের কথায়, “এই নির্বাচন শুধু একজন মেয়রের নয়—এটা নির্ধারণ করবে নিউইয়র্ক কাদের শহর।”

বিজয় ভাষণের সময় মামদানির পাশে ছিলেন তাঁর বাবা-মা—খ্যাতনামা পণ্ডিত মাহমুদ মামদানি ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ার। ৭৯ বছর বয়সি মাহমুদ মামদানি ভারতের মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করলেও শৈশব কেটেছে উগান্ডায়, যেখানে তাঁর পুত্র জোহরানেরও জন্ম। তিনি একজন বিশিষ্ট নৃবিজ্ঞানী এবং বর্তমানে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পাশাপাশি উগান্ডার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন।

৬৮ বছর বয়সি মীরা নায়ার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র জগতে এক উজ্জ্বল নাম। ভারতের সমাজ-পরিবর্তন ও প্রবাসী ভারতীয় জীবনের সংকট নিয়ে নির্মিত একাধিক জনপ্রিয় সিনেমা তাঁকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে ‘মিসিসিপি মাসালা’ (ডেনজেল ওয়াশিংটন অভিনীত) এবং ‘মনসুন ওয়েডিং’।

‘মিসিসিপি মাসালা’ ছবিটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে ইদি আমিনের শাসনামলে উগান্ডা থেকে দক্ষিণ এশীয়দের বিতাড়নের প্রেক্ষাপটে—যে সময় সেই বাস্তবতার শিকার হয়েছিলেন মাহমুদ মামদানিও। অন্যদিকে, ‘মনসুন ওয়েডিং’ ভারতীয় পারিবারিক কাঠামোর ভেতর শিশু যৌন নির্যাতনের মতো এক ট্যাবু বিষয়কে প্রথমবার বড় পর্দায় এনেছিল।

বিজয় বক্তৃতায় জোহরান মামদানি বলেন, “আমার এই জয় এক রাজনৈতিক রাজবংশের পতন। ইতিহাসে খুব কম সময়েই এমন মুহূর্ত আসে,”—এ কথা তিনি ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বিখ্যাত উক্তি উদ্ধৃত করে বলেন।

তিনি আরও যোগ করেন, “ডোনাল্ড ট্রাম্প, তোমার জন্য আমার চারটি শব্দ—Turn the volume up!”—এ কথা বলতেই উপস্থিত জনতার মধ্যে প্রবল করতালির ঢেউ ওঠে। মামদানি তাঁর ভাষণে ট্রাম্পের প্রতি সরাসরি আক্রমণ চালিয়ে বলেন, ট্রাম্প বারবার কর ফাঁকি দিয়ে সাধারণ মানুষের প্রাপ্য সম্পদ লুণ্ঠন করেছেন এবং নিজের কর্পোরেট বন্ধুদের রক্ষা করেছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, “আমরা নিউইয়র্কে দুর্নীতির এই সংস্কৃতি শেষ করব।”

এদিকে ভার্জিনিয়ায় ডেমোক্র্যাট অ্যাবিগেইল স্প্যানবার্গার গভর্নর পদে জয়ী হয়ে রাজ্যের প্রথম নারী গভর্নর হিসেবে ইতিহাস গড়েছেন। নিউ জার্সিতেও ডেমোক্র্যাট মিকি শেরিল গভর্নর নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন।

এই তিনটি নির্বাচন—নিউইয়র্ক, ভার্জিনিয়া ও নিউ জার্সি—২০২৬ সালের মধ্যবর্তী কংগ্রেস নির্বাচনের এক বছর আগে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জন্য ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। গত বছর ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাতীয় জয়ের পর থেকে ওয়াশিংটনে ক্ষমতার বাইরে থাকা ডেমোক্র্যাটরা এখন নতুন করে পথ খুঁজছে রাজনৈতিক অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য।