আজকাল ওয়েবডেস্ক: চতুর্দশ শতকের শেষভাগে ইউরোপ জুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছিল ব্ল্যাক ডেথ। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে এই মহামারিতে প্রাণ হারান কয়েক কোটি মানুষ, ইউরোপের জনসংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। বহুদিন ধরেই বিজ্ঞানীরা জানেন, এই প্লেগের জন্য দায়ী ছিল ব্যাকটেরিয়া ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস, যা মূলত ইঁদুর ও পিসুর মাধ্যমে ছড়াত। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে—কীভাবে এত দ্রুত গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ল এই রোগ, আর ঠিক সেই সময়েই বা কেন ভয়াবহ রূপ নিল?
সম্প্রতি কমিউনিকেশনস আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত এক নতুন গবেষণা এই রহস্যে নতুন দিক যোগ করেছে। গবেষকদের দাবি, ব্ল্যাক ডেথের সূত্রপাত শুধু যুদ্ধ বা বাণিজ্যের কারণে হয়নি, এর পেছনে বড় ভূমিকা ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের, যা সম্ভবত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে সৃষ্টি হয়েছিল।
গবেষণা অনুযায়ী, ১৩৪৫ ও ১৩৪৬ সালে ইউরোপে পরপর দু’টি অস্বাভাবিক গ্রীষ্মকাল দেখা দেয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আগ্নেয়গিরির ছাই বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে সূর্যালোক আটকে দেওয়ার ফলেই এই শীতল আবহাওয়া তৈরি হয়। এর জেরে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
ফসল নষ্ট হওয়ায় ইতালির শক্তিশালী নগর বিশেষ করে ভেনিস ও জেনোয়া—খাদ্য সঙ্কটে পড়ে। বাধ্য হয়ে তারা আবার কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের সঙ্গে শস্য বাণিজ্য শুরু করে, ঠিক সেই সময়েই ওই অঞ্চলে প্লেগ সক্রিয় ছিল।
অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির ইতিহাসবিদ হান্না বার্কার, যিনি এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, বলেন, “ব্ল্যাক ডেথ বোঝার ক্ষেত্রে এটি এক নতুন টুকরো যোগ করল। আগে জলবায়ুর দিকটি কেউ গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি।”
গবেষণার সূত্র ধরতে বিজ্ঞানীরা গাছের বলয় ও বরফের স্তর বিশ্লেষণ করেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেনড্রোক্রোনোলজিস্ট উলফ বুন্তগেন লক্ষ্য করেন, পিরেনিজ পর্বতমালার গাছগুলো ১৩৪৫ ও ১৩৪৬ সালে স্বাভাবিকভাবে বাড়তে পারেনি। ইউরোপের আরও আটটি অঞ্চলের গাছের মধ্যেও এই পরিস্থিতির লক্ষণ দেখা যায়।
একই সময় গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকার বরফের স্তরে সালফারের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রমাণ মিলেছে, যা বড় ধরনের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ইঙ্গিত দেয়। ঐতিহাসিক নথিতেও দেখা যায়, ১৩৪৫ থেকে ১৩৪৭ সাল পর্যন্ত জাপান থেকে ফ্রান্স—বিভিন্ন অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে মেঘলা আকাশের উল্লেখ রয়েছে।
ইতালিতে এই সময় ফসল উৎপাদন ব্যর্থ হয় এবং শস্যের দাম ৮০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায়। খাদ্যভাণ্ডার ফুরিয়ে আসতেই নগরের বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পরিস্থিতির চাপে তারা কৃষ্ণসাগরের সঙ্গে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়, যদিও ওই এলাকায় মঙ্গোল বাহিনীর মধ্যে প্লেগ বহুদিন ধরেই ছড়িয়ে পড়েছিল।
গবেষকদের মতে, শস্যের বস্তার সঙ্গে পিসু এসে ইউরোপে পৌঁছায়। বন্দরে শস্য নামানোর পর পিসুগুলো স্থানীয় ইঁদুরে, সেখান থেকে মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এই কারণেই প্রথমে ভেনিস ও জেনোয়ার মতো আমদানি-নির্ভর অঞ্চলগুলোতে প্লেগ আঘাত হানে, আর রোম বা মিলানের মতো স্বনির্ভর শহরগুলোতে পরে পৌঁছায়।
