আজকাল ওয়েবডেস্ক: আলাস্কায় শুক্রবারের ট্রাম্প–পুতিন সম্মেলন কেবল এক ভূরাজনৈতিক প্রদর্শনী নয়, বরং ভারতের জন্য এট একটা প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক প্রভাব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই রাশিয়ান তেল কেনাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে নয়াদিল্লি গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছিল, এই বৈঠক কি চাপ কিছুটা কমাবে, নাকি আরও বাড়াবে।

 

সম্মেলনের চিত্র

 

শুক্রবার সকালে আলাস্কার জয়েন্ট বেস এলমেনডর্ফ–রিচার্ডসনে নেমে আসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং প্রায় আধঘণ্টা পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। “Alaska 2025” লেখা লাল গালিচায় দাঁড়িয়ে দুই নেতা হাত মেলান। চারটি এফ–২২ যুদ্ধবিমান আর এক বি–২ স্টেলথ বোম্বারের উড়ান ছিল অনুষ্ঠানের আকর্ষণ।

 

আনুষ্ঠানিক আলোচনায় যোগ দেওয়ার আগে ট্রাম্প প্রোটোকল ভেঙে পুতিনকে তাঁর গাড়িতে বসিয়ে স্বল্প সময়ের একান্ত আলাপ করেন। সকাল ১১টা ৩০ থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা চলে বৈঠক। ট্রাম্প ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফকে নিয়ে, আর পুতিনের পাশে ছিলেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ও উপদেষ্টা ইউরি উশাকভ।

 

বিকেল তিনটার সময় দুই নেতা সংবাদমাধ্যমের সামনে উপস্থিত হলেও কোনও বড় ঘোষণা করেননি। ছয় ঘণ্টারও কম সময়ের সফর শেষে পুতিন মস্কো ফিরে যান।

 

যুদ্ধবিরতির খোঁজে ব্যর্থতা

 

বৈঠকের আগে ট্রাম্প আশা করেছিলেন, অন্তত ইউক্রেন যুদ্ধবিরতিতে কিছু অগ্রগতি হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তেমন কোনও সমঝোতা হয়নি। তবু আশাবাদী সুরে ট্রাম্প বলেন, “অনেক অগ্রগতি হয়েছে। আলোচনা চলবে, আরও বৈঠক হবে।”

 

পুতিনও একইভাবে জানান, আলোচনার পরিবেশ ছিল “গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ।” পাশাপাশি তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন, ইউক্রেন সংকটের মূল কারণগুলো সমাধান না হলে স্থায়ী শান্তি সম্ভব নয়।

 

পুতিনের কূটনৈতিক লাভ

 

বিশ্লেষকদের মতে, বৈঠকটি পুতিনের জন্য বড়সড় কূটনৈতিক সাফল্য। তিনি কোনো ছাড় না দিয়েই লাভবান হয়েছেন। মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট বৈঠককে আখ্যা দিয়েছে “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়।” নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, “পুতিন একঘরে অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সমান মর্যাদায় দাঁড়িয়েছেন।”

 

মস্কোতেও আনন্দোৎসব। রুশ নিরাপত্তা দপ্তরের উপপ্রধান দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেন, “আলোচনা ছিল হুমকি–বিহীন ও শান্তিপূর্ণ। প্রেসিডেন্ট পুতিন সরাসরি আমাদের শর্তগুলো উপস্থাপন করেছেন।”

 

ইউরোপ ও ইউক্রেনের প্রতিক্রিয়া

 

ইউরোপীয় দেশগুলো (জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইতালি ও ইইউ) যৌথ বিবৃতিতে জানায়, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে তারা অনড় থাকবে। একইসঙ্গে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতিও পুনর্ব্যক্ত করে।

 

কিয়েভ কিছুটা আশাবাদী হলেও সতর্ক। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে অন্তর্ভুক্ত করে ত্রিপাক্ষিক ফরম্যাটে আলোচনার পক্ষে তিনি। তবে তিনি জোর দেন, “শুধু যুদ্ধবিরতি নয়, স্থায়ী শান্তির জন্য ইউরোপীয় অংশগ্রহণ জরুরি।”

 

কিন্তু ট্রাম্প পরে ফক্স নিউজে বলেন, “রাশিয়া এক বৃহৎ শক্তি, ইউক্রেন তা নয়। জেলেনস্কিকে একটা চুক্তি করতেই হবে।” তাঁর এই মন্তব্যে ইউক্রেন ও ইউরোপে উদ্বেগ বেড়েছে।

 

ভারতের প্রতিক্রিয়া: স্বস্তি না অস্বস্তি?

 

ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠককে স্বাগত জানিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র রন্ধির জয়সওয়াল বলেন, “ভারত সর্বদাই সংলাপ ও কূটনীতির পক্ষে। আলাস্কার বৈঠককে আমরা ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখি।”

 

কিন্তু নেপথ্যে নয়াদিল্লির চিন্তা অন্যত্র। যুক্তরাষ্ট্র ৫০ শতাংশ আমদানি শুল্ক এবং রাশিয়ান তেল আমদানিতে ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক চাপিয়েছে। ফলে ভারতীয় অর্থনীতি বড় আঘাতের মুখে। চীনের ওপর আপাতত নিষেধাজ্ঞা না চাপালেও, ভারতের জন্য এই চাপ অব্যাহত থাকবে কিনা তা অনিশ্চিত।

 

সাবেক কূটনীতিক অজয় বিসারিয়া দ্য ওয়ায়ার–কে বলেন, “প্রথম স্বস্তির খবর হলো বৈঠক ভেঙে যায়নি। ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, হয়তো ভারতকে আরও সময় দেবেন কিংবা শুল্ক শিথিল করবেন।”

 

তবে তিনি সতর্ক করেন, ইউক্রেনে হঠাৎ পরিস্থিতি খারাপ হলে এই ‘সম্ভাব্য সুযোগ’ নষ্ট হতে পারে।

 

সামনে কী?

 

আলাস্কার বৈঠক আপাতত কোনো বড় সমাধান না দিলেও বিশ্বরাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। ট্রাম্প–পুতিনের ঘনিষ্ঠতা ইউরোপ ও ইউক্রেনকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। আর ভারত তাকিয়ে আছে হোয়াইট হাউসের পরবর্তী সিদ্ধান্তের দিকে—শুল্ক কি কমবে, নাকি চাপ আরও বাড়বে।

 

একইসঙ্গে নয়াদিল্লির জন্য বার্তা পরিষ্কার: রুশ জ্বালানি নির্ভরতা বজায় রেখে ওয়াশিংটনের সঙ্গেও সমীকরণ সামলাতে হবে। এখন প্রশ্ন, ট্রাম্পের কূটনীতি ভারতের জন্য সুযোগ বয়ে আনবে, নাকি নতুন বিপদ।