আজকাল ওয়েবডেস্ক: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত অগ্রগতির ফলে সাহিত্য জগতে অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ ও বিতর্ক ক্রমেই বাড়ছে। নতুন এক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, ভবিষ্যতে হয়তো সাহিত্য জগতে দেখা যাবে দুই ধরনের শ্রেণি—একদিকে থাকবে মানবসৃষ্ট সাহিত্য, যা হবে ব্যয়বহুল, অন্যদিকে থাকবে এআই-জেনারেটেড বই, যা হবে সস্তা কিংবা একেবারে বিনামূল্যে।
ঘটনার সূত্রপাত একটি বাক্য দিয়ে—“On the morning the truth began to unstitch itself, Leonard felt a faint, traitorous thrill…”। বাক্যটি পড়লে সহজেই মনে হতে পারে এটি বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক ইয়ান ম্যাকইউয়ানের কোনও নতুন উপন্যাসের সূচনা। কিন্তু বাস্তবে এটি একটি সাধারণ এআই টুল দ্বারা তৈরি, যা কেবল লেখকের শৈলী অনুকরণ করেছে। যদিও বাক্যটি যথেষ্ট অলঙ্কৃত, তবে যেকোনো সাধারণ পাঠকের কাছে এটি ‘খুব কাছাকাছি’।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় প্রকাশিত উদ্বেগ
এই বিষয়টিই উঠে আসে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে। গবেষণায় যুক্তরাজ্যের প্রকাশিত লেখকদের অর্ধেকের বেশি মত দিয়েছেন—অদূর ভবিষ্যতে এআই তাদের কাজ পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করতে পারে। গবেষণার নেতৃত্ব দেন লেখক ও গবেষক ড. ক্লিমেন্টাইন কোলেট। তাঁর আশঙ্কা—“মানব রচিত বই ভবিষ্যতে বিলাসী পণ্যে পরিণত হতে পারে; বিপরীতে এআই বই থাকবে সস্তায় বা বিনামূল্যে।”
কোলেট মনে করেন, এর পরিণাম হতে পারে গুরুতর—সাহিত্য আর সবার জন্য সমানভাবে সহজলভ্য থাকবে না।
এআই-সৃষ্ট লেখা: জনপ্রিয়তা ও বিপত্তি
ইতিমধ্যেই দেখা গেছে, পাঠকদের বড় একটি অংশ এআই-জেনারেটেড লেখা পড়তে আগ্রহী, বিশেষ করে নন-ফিকশন ক্ষেত্রে। যুক্তি—নন-ফিকশন যেহেতু তথ্যভিত্তিক, সেহেতু ‘ঠাণ্ডা নির্যাস’ হিসেবে এআইই যেন উপযুক্ত মাধ্যম। কিন্তু সাহিত্য সমালোচকদের প্রশ্ন—তথ্য উপস্থাপনের মধ্যেও মানবিক অনুভূতি, অভিজ্ঞতা, ভাষার সূক্ষ্মতা ও সৃজনশীলতার ছাপ থাকে, যা যন্ত্র অনুকরণ করলেও তৈরি করতে পারে না।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—জনপ্রিয় ঘরানাভিত্তিক সাহিত্য, বিশেষ করে রোম্যান্স ও ক্রাইম ফিকশন। এগুলো তুলনামূলকভাবে কাঠামোগত এবং পুনরাবৃত্তিমূলক হওয়ায় এআই সহজেই তা নকল করতে পারছে। বিশাল পাঠকচাহিদার কারণে ভবিষ্যতে প্রকাশনা বাজার এআই-নির্ভর হয়ে পড়তে পারে—এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
বিনোদন জগতে একই প্রবণতা
এই বাস্তবতা শুধু সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ২০২৩ সালে মার্ভেল তাদের একটি সিরিজে এআই অ্যানিমেশন ব্যবহার করলে সমালোচনা হয়েছিল। কিন্তু মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে এমন ঘটনার বিরোধিতা কমে এসেছে। সম্প্রতি নেটফ্লিক্সেও একটি সিরিজে একটি বিল্ডিং ধ্বংসের দৃশ্য এআই দিয়ে তৈরি করা হয়। বিতর্ক উঠলেও তা আগের মতো ব্যাপক ছিল না।
সাহিত্য কি প্রযুক্তির কাছে পরাজিত হবে?
অনেকে অবশ্য আশাবাদী। উদীয়মান ব্রিটিশ লেখক টোবি কোভেন্ট্রি মনে করেন—“মানবিক সৃজনশীলতা কখনও বিলুপ্ত হবে না। মানুষ সবসময় জানতে চাইবে গল্পটির পেছনে থাকা মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের কথা।” তাঁর মতে, উদ্বেগ নয়—লেখার ধারাবাহিকতা বজায় রাখাই এ পরিস্থিতির মোকাবিলার উপায়।
সমাজে সম্ভাব্য বিভাজন
যুক্তরাজ্যের ২০২২ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, সেখানে প্রতি পাঁচজন শিশুর একজনের কাছে নিজের কোনও বই নেই। ইতিমধ্যেই পড়ার অধিকার অসম। যদি ভবিষ্যতে মানবসৃষ্ট সাহিত্য কেবল ধনীদের জন্য সংরক্ষিত হয়, তবে তা হবে বিপজ্জনক সাংস্কৃতিক বৈষম্য। ড. কোলেট সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন—এআই ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ ও সুনির্দিষ্ট নীতি জরুরি, না হলে সাহিত্য শিল্পে দুঃসহ সংকট তৈরি হবে।
এআই-সৃষ্ট লেখা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর—তবে অনুকরণ আর সৃষ্টির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। যতই পরিপাটি হোক, কোনও এআই কখনও ইয়ান ম্যাকইউয়ানের বাক্যের জায়গা নিতে পারবে না—কারণ লেখনীর ভেতরে লুকিয়ে থাকে মানবিক অভিজ্ঞতা, আবেগ ও সৃজনশীলতার স্মৃতি—যা অ্যালগরিদমে শেখানো যায় না।
