আজকাল ওয়েবডেস্ক: ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারের বাসিন্দা এবং দুই সন্তানের বাবা ৬০ বছর বয়সী ফ্র্যাঙ্ক লেন সম্প্রতি এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন। গত বছরের নভেম্বরে, শেভ করার সময় আচমকাই গলার ডানদিকে ডিমের আকারের শক্ত একটি ফোলা অংশ অনুভব করেন তিনি। প্রাথমিকভাবে ভাবেন, হয়তো জিমে অতিরিক্ত শরীরচর্চার ফলে গ্ল্যান্ড ফুলে গেছে। কিন্তু দুই সপ্তাহ কেটে গেলেও সেই ফোলাভাব না কমায় তিনি চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। চিকিৎসক তাঁকে জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য পাঠান এবং কিছু দিনের মধ্যেই জানা যায়—তিনি গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত। কিন্তু যা শুনে তিনি থমকে যান, তা হলো—এই ক্যান্সারের মূল কারণ হল হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (HPV), যা ওরাল সেক্সের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করেছিল বহু বছর আগে।
চিকিৎসকরা জানান, বায়োপসির রিপোর্ট অনুযায়ী এই ভাইরাস তাঁর শরীরে প্রায় ৪০ বছর আগে প্রবেশ করে থাকতে পারে, সম্ভবত তখন যখন তিনি ২০ বছর বয়সে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। বর্তমানে, একাধিক ধাপের কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি গ্রহণের পর ফ্র্যাঙ্ক লেন এখন "নো এভিডেন্স অফ ডিজিজ" অবস্থায় রয়েছেন, অর্থাৎ তাঁর শরীরে আপাতত ক্যান্সারের কোনও উপস্থিতি নেই। তবে তিনি প্রতি দুই মাস অন্তর নিয়মিত চেকআপ করাচ্ছেন। লেন জানান, যখন চিকিৎসক তাঁকে বলেন তাঁর গলার ক্যান্সার ওরাল সেক্সের কারণে হয়েছে, তখন তিনি যেন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সহকর্মীদের অনেকেই প্রথমে বিষয়টিকে হাস্যকর মনে করেছিলেন। পরে যখন তাঁরা ইন্টারনেটে তথ্য যাচাই করে দেখেন, তখন তাঁদের মুখ থেকে রং উড়ে যায়।
তিনি বলেন, “আমি যখন ডাক্তারকে বললাম এটা হয়তো গ্ল্যান্ড ফুলেছে, তখনও বুঝিনি বিষয়টা এতটা গুরুতর হতে পারে। পরে যখন গলার ভেতর থেকে টনসিলের ওপরে একটা ডিমের মতো জিনিস বেরিয়ে আসতে দেখা গেল, তখন চিকিৎসকরা নিশ্চিত হন এটা সাধারণ ফোলা নয়।”
চিকিৎসকরা লেনকে প্রথমে দুই রাউন্ড কেমোথেরাপি দেন, এরপর ছয় সপ্তাহ ধরে রেডিওথেরাপি চলে। তিনি বলেন, “আমি ১২ বছর সেনাবাহিনীতে ছিলাম, কিন্তু রেডিওথেরাপির মতো যন্ত্রণাদায়ক কিছু কখনও অনুভব করিনি।” এই অভিজ্ঞতার পর ফ্র্যাঙ্ক লেন সবাইকে অনুরোধ করছেন—যেকোনও অস্বাভাবিক উপসর্গ দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে। তাঁর কথায়, “আমার পরামর্শ, ওরাল সেক্স না করাই ভালো। আর যদি কেউ সেটা করতে না পারে, তাহলে অন্তত শরীরে কোনও অস্বাভাবিকতা দেখলেই অবহেলা না করে পরীক্ষা করান।”
HPV বা হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস সাধারণভাবে যৌন সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শরীর নিজে থেকেই এই ভাইরাসকে নির্মূল করতে পারে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে, এই ভাইরাস শরীরের সুস্থ কোষে ক্যান্সারজনিত পরিবর্তন আনতে পারে। HPV ভাইরাস মূলত জরায়ুমুখ, পায়ুপথ, পুরুষাঙ্গ এবং গলার ক্যান্সারের জন্য দায়ী। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে মাথা ও গলার ক্যান্সারের হার দ্রুত বাড়ছে এবং এর একটি বড় কারণ ওরাল সেক্সের মাধ্যমে HPV সংক্রমণ। এমনকি হলিউড তারকা মাইকেল ডগলাসও একবার জানিয়েছিলেন যে তাঁর গলার ক্যান্সারের কারণ ছিল ওরাল সেক্স।
ইংল্যান্ডে প্রতিবছর প্রায় ১২,৫০০ জনের মধ্যে হেড অ্যান্ড নেক ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং প্রায় ৪,০০০ জন এই রোগে মারা যান। এই ধরনের ক্যান্সার পুরুষদের মধ্যে মহিলাদের তুলনায় ২-৩ গুণ বেশি দেখা যায়। HPV প্রতিরোধে টিকা থাকলেও, যুক্তরাজ্যে এই টিকার গ্রহণযোগ্যতার হার এখনও আশঙ্কাজনকভাবে কম। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে মেয়েদের মধ্যে মাত্র ৬৭.২% টিকা সম্পূর্ণ করেছিলেন, যেখানে ২০১৩-১৪ সালে এই হার ছিল ৮৬.৭%। ছেলেদের মধ্যে এই হার আরও কম—মাত্র ৬২.৪%। উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্যে ২০০৮ সাল থেকে ৮ম শ্রেণির মেয়েদের এবং ২০১৯ সাল থেকে ছেলেদের এই টিকা দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মতে, ডেনমার্কে এই টিকার গ্রহণযোগ্যতার হার প্রায় ৮০ শতাংশ, যেখানে যুক্তরাজ্যে তা অর্ধেকেরও কম।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, HPV টিকাকে শুধুই জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধকারী হিসেবে তুলে ধরায় এবং যৌনতার সঙ্গে যুক্ত করার ফলে অনেকে টিকা নিতে দ্বিধাগ্রস্ত হন। ফ্র্যাঙ্ক লেনের অভিজ্ঞতা এই বিষয়গুলিকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে। তাঁর জীবনযুদ্ধ একদিকে যেমন ভয়ঙ্কর বাস্তবতা, তেমনই অন্যদিকে সামাজিক কুসংস্কার ও লজ্জার কারণে HPV সংক্রান্ত সচেতনতার অভাব কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তার বাস্তব প্রমাণ। তিনি আজ বেঁচে আছেন, তবে তাঁর কথাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—"যেকোনও অস্বাভাবিকতা অবহেলা করবেন না। জীবন বাঁচাতে সচেতনতা জরুরি।"
