আজকাল ওয়েবডেস্ক: মহাকাশ অনুসন্ধানের যুগে যুগে একটি বড় সীমাবদ্ধতাই মেনে এসেছে—জ্বালানি। পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপিত প্রতিটি রকেটই বিপুল পরিমাণ প্রপেল্যান্ট বা জ্বালানি বহন করে, যা মহাকাশযানকে শক্তি দেয়, আবার একই সঙ্গে তাকে সীমাবদ্ধও করে। কারণ জ্বালানি যত বেশি, রকেট তত ভারী; ফলে থ্রাস্ট, ওজন ও পেলোডের মধ্যে একটি জটিল ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। ২০ শতকের শুরুতে কনস্ট্যানটিন সিওলকোভস্কি যে রকেট উদ্ভাবন করেছিলেন, সেই নীতিই দীর্ঘদিন ধরে মহাকাশযাত্রার মূল ভিত্তি।
কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে—একটি এমন ভবিষ্যৎ যেখানে মহাকাশযানকে হয়তো আর কোনও জ্বালানি বহনই করতে হবে না। arXiv প্রিপ্রিন্ট সার্ভারে প্রকাশিত একটি বিস্তৃত পর্যালোচনা দেখিয়েছে ‘প্রপেল্যান্টলেস’ বা জ্বালানিবিহীন কয়েকটি সম্ভাব্য মহাকাশ প্রপালশনের ধরন, যা প্রকৃতির নিজস্ব শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মহাকাশ ভ্রমণের নিয়মই বদলে দিতে পারে।
সোলার সেল: সূর্যালোকের চাপে এগিয়ে চলা মহাকাশযান
জ্বালানিবিহীন প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিণত ও বাস্তবসম্মত হল সোলার সেল। এই পদ্ধতিতে বিশাল, আল্ট্রা-লাইট প্রতিফলিত পালের ওপর সূর্যের আলো— যথার্থভাবে বলতে গেলে ফোটন—একটানা চাপ প্রয়োগ করে। এই চাপ খুব ক্ষুদ্র হলেও, তা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে মহাকাশযানকে দীর্ঘ সময়ে উল্লেখযোগ্য গতিতে পৌঁছে দিতে পারে।
২০১০ সালে জাপানের মিশন এই প্রযুক্তির প্রথম সফল প্রদর্শন করে, যেখানে শুধুমাত্র সূর্যালোকের চাপ ব্যবহার করে মহাকাশযানটি শুক্র গ্রহের কক্ষপথে পৌঁছায়। সোলার সেলের সবচেয়ে বড় সুবিধা এর কোনও জ্বালানির প্রয়োজন নেই।
তবে সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। সূর্য থেকে দূরে গেলে আলোর তীব্রতা কমে যাওয়ায় সোলার সেলের প্রভাব দ্রুত হ্রাস পায়। এছাড়া বহু কিলোমিটার বিস্তৃত অতিলঘু সেল তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ করাও প্রকৌশলগতভাবে চ্যালেঞ্জিং।
সবচেয়ে প্রাচীন, পরীক্ষিত এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত ‘জ্বালানিবিহীন’ কৌশল হল গ্রাভিটি অ্যাসিস্ট বা মহাকর্ষীয় সহায়তা। কোনও গ্রহের কাছ দিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে অতিক্রম করলে তার কক্ষগতির একটি ক্ষুদ্র অংশ ব্যবহার করে মহাকাশযান গতি বাড়াতে পারে। NASA-র Voyager মহাকাশযান এই কৌশল ব্যবহার করেই এক মিশনে চারটি বাইরের গ্রহ পরিদর্শন করেছিল।
এর বড় সুবিধা—এটির জন্য কোনও নতুন উপাদান বা জটিল প্রযুক্তির প্রয়োজন পড়ে না, কেবল নিখুঁত পরিকল্পনা ও সঠিক সময় নির্ধারণই যথেষ্ট। তবে অসুবিধা হল, এই সুযোগ খুব কম আসে, কারণ গ্রহগুলোর অবস্থান সদা পরিবর্তনশীল। একবার পথ নির্ধারিত হয়ে গেলে তা সংশোধন করাও কঠিন।
আধুনিক গবেষণা সূর্যের ক্রমাগত বহির্গত চার্জযুক্ত কণার বায়ুপ্রবাহ—সোলার উইন্ড—ব্যবহার করার দিকেও নজর দিয়েছে। ম্যাগনেটিক সেল বিশাল সুপারকন্ডাক্টিং লুপ তৈরি করে বিপুল চৌম্বক ক্ষেত্র সৃষ্টি করবে, যা সোলার উইন্ডকে প্রতিফলিত করে থ্রাস্ট তৈরি করবে। অন্যদিকে ইলেকট্রিক সেল তুলনামূলক হালকা; এটি দীর্ঘ চার্জযুক্ত তার ব্যবহার করে সোলার উইন্ড প্রোটনকে দূরে ঠেলে দেয়।
এই দুই প্রযুক্তি নিরবচ্ছিন্ন গতি বাড়ানোর ক্ষমতা রাখে এবং দীর্ঘ মেয়াদে সোলার সেলের চেয়েও বেশি কার্যকর হতে পারে বলে গবেষকরা মনে করছেন। কিন্তু এর প্রযুক্তিগত বাধা অনেক বড়। ম্যাগনেটিক সেলের জন্য দশ কিলোমিটার প্রশস্ত কয়েলকে শীতল তাপমাত্রায় রাখতে হবে, আর ইলেকট্রিক সেলের জন্য আল্ট্রা-থিন, অত্যন্ত শক্তিশালী ও উচ্চ-ভোল্টেজে চালিত টেথারের প্রয়োজন।
গ্রাভিটি অ্যাসিস্ট ইতিমধ্যেই কার্যকর, সোলার সেল মহাকাশে সক্রিয়ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, আর ম্যাগনেটিক বা ইলেকট্রিক সেলের মতো প্রযুক্তি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জ্বালানিবিহীন মহাকাশযাত্রার নতুন সম্ভাবনা উন্মুক্ত করছে। প্রকৃতির শক্তিকেই প্রপালশন হিসেবে ব্যবহার করে মহাকাশযানকে জ্বালানির সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করার এই প্রচেষ্টাই হয়তো একদিন আমাদের সৌরজগতের বহু দূর অতীতেও নিয়ে যেতে পারে।
