আজকাল ওয়েবডেস্ক: এই বছর কেনটাকির এক কিশোর আত্মহত্যা করার পর, তার পরিবার আবিষ্কার করে যে সে একটি এআই-উৎপাদিত নগ্ন ছবি গোপন রাখতে ৩,০০০ মার্কিন ডলার দাবি করে পাঠানো হুমকিমূলক বার্তার শিকার হয়েছিল। এই ট্র্যাজেডি আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে, শিশু-কিশোরদের লক্ষ্য করে চালানো তথাকথিত "সেক্সটরশন" (যৌন হুমকি ও ব্ল্যাকমেল) স্ক্যাম বিশ্বের নানা প্রান্তে দ্রুত বাড়ছে। বিশেষ করে “নিউডিফাই” অ্যাপের দ্রুত বিস্তার এই পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে — এগুলো এমন এআই টুল যা ডিজিটালভাবে জামাকাপড় সরিয়ে যৌন চিত্র তৈরি করতে পারে।

১৬ বছর বয়সী এলিজাহ হিকক এমনই হাজার হাজার আমেরিকান কিশোরের একজন, যাদের টার্গেট করা হয়েছে এই ধরনের ডিজিটাল ব্ল্যাকমেল চালিয়ে। তাঁর মৃত্যু নতুন করে টেক কোম্পানি ও নিয়ন্ত্রকদের উপর কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি তুলেছে। হিককের বাবা-মা মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ওই হুমকিমূলক মেসেজে বলা হয়েছিল — যদি টাকা না দেয়, তাহলে ওই এআই-তৈরি নগ্ন ছবি তার বন্ধু ও পরিবারের কাছে পাঠানো হবে। “যারা আমাদের সন্তানদের পেছনে লেগেছে, তারা খুব সংগঠিত, তারা অর্থে সাশ্রয়ী নয়, এবং তারা নৃশংস,” ছেলের মৃত্যুর পরে CBS News-এ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন হিককের বাবা জন বার্নেট। “তাদের আসল ছবি দরকার পড়ে না — তারা যেটা চায়, সেটা বানিয়েই ব্ল্যাকমেল করে।”

এই ঘটনায় মার্কিন তদন্তকারী সংস্থাগুলি তদন্ত শুরু করেছে। এদিকে, ‘নিউডিফাই’ অ্যাপগুলি যেগুলি মূলত সেলিব্রিটিদের লক্ষ্য করে তৈরি হয়েছিল, সেগুলি এখন শিশুদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যাপক হারে বাড়ছে সেক্সটরশন। FBI জানিয়েছে, মার্কিন কিশোরদের লক্ষ্য করে সেক্সটরশন কেস “ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে”, যার শিকার সাধারণত ১৪ থেকে ১৭ বছরের কিশোর ছেলেরা। এ ধরনের হুমকির ফলে “আত্মহত্যার উদ্বেগজনক হার” দেখা যাচ্ছে বলে এফবিআই সতর্ক করেছে। অনলাইন শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে কাজ করা সংস্থা থর্নের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৬% মার্কিন কিশোর-তরুণ সরাসরি ডিপফেক নগ্নতার শিকার হয়েছে।

ব্রিটিশ ওয়াচডগ Internet Watch Foundation (IWF) জানিয়েছে, এইসব নিউডিফাই সেবার মাধ্যমে তৈরি করা চিত্রের সঙ্গেই অর্থনৈতিক সেক্সটরশনের যোগ রয়েছে। “প্রত্যক্ষ ছবি দরকার পড়ে না। শুধু বাস্তব বলেই যে কোনও ছবি ক্ষতিকর, তা নয় — এই প্রযুক্তির তৈরি ছবিও বাস্তবের মতোই ধ্বংসাত্মক হতে পারে,” জানিয়েছে সংস্থাটি। IWF এমন একটি “পিডোফাইল গাইড” চিহ্নিত করেছে যা স্পষ্টভাবে এই ধরনের টুল ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুদের ব্ল্যাকমেল করার কৌশল শেখায়। গাইডের লেখক দাবি করেছে, সে ১৩ বছর বয়সী কিশোরীদের ব্ল্যাকমেল করতে সফল হয়েছে। ‘ইন্ডিকেটর’ নামক মার্কিন গণমাধ্যমের বিশ্লেষণ বলছে, নিউডিফাই সেবা দেওয়া ৮৫টি ওয়েবসাইট একত্রে বছরে প্রায় ৩.৬ কোটি ডলার (৩৬ মিলিয়ন) আয় করতে পারে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে ১৮টি ওয়েবসাইট শুধুমাত্র জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ৬ মাসে প্রায় ২.৬ মিলিয়ন থেকে ১৮.৪ মিলিয়ন ডলার উপার্জন করেছে। এই সাইটগুলির বেশিরভাগই Google, Amazon, এবং Cloudflare-এর প্রযুক্তিগত পরিকাঠামোর ওপর নির্ভর করে চলে এবং বড় বড় টেক কোম্পানি ও সরকারের পদক্ষেপ সত্ত্বেও লাভজনকভাবে টিকে আছে।

 আরও পড়ুন: বাবার সম্পত্তিতে সমান অধিকার আছে মেয়েদের: শীর্ষ আদালত


বিশ্বজুড়ে স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কিশোর-কিশোরীদের নিজেদের সহপাঠী বা শিক্ষকদের যৌনায়িত ছবি তৈরি করে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় এই এআই টুলগুলোর অপব্যবহার বাড়ছে। Save the Children–এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, স্পেনে প্রতি পাঁচজন তরুণ-তরুণীর মধ্যে একজন ডিপফেক নগ্নতার শিকার হয়েছে এবং সেইসব ছবি তাদের অজ্ঞাতসারে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে। এ বছর স্পেনের পুয়ের্তোল্লানো শহরে তিনজন নাবালককে তাদের স্কুলের সহপাঠী ও শিক্ষকদের লক্ষ্য করে এআই-তৈরি পর্নোগ্রাফিক ছবি তৈরি ও ছড়ানোর অভিযোগে তদন্ত করা হয়।

ব্রিটেনে এ বছর থেকে যৌন উদ্দেশ্যে ডিপফেক তৈরি করাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে — এর জন্য দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, মে মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প Take It Down Act নামে একটি আইন সই করেন, যেখানে সম্মতি ছাড়া অন্তরঙ্গ ছবি অনলাইনে পোস্ট করাকে অপরাধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং প্ল্যাটফর্মগুলিকে তা দ্রুত সরিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে। Meta (ফেসবুকের মূল সংস্থা) সম্প্রতি Crush AI নামক একটি নিউডিফাই অ্যাপের বিরুদ্ধে হংকং-ভিত্তিক এক কোম্পানিকে আদালতে টেনেছে, যারা Meta-র বিজ্ঞাপন নীতিকে বারবার ফাঁকি দিয়ে প্ল্যাটফর্মে অ্যাড চালিয়েছে।

তবে এত কিছু সত্ত্বেও গবেষকরা জানিয়েছেন, এই ধরনের সাইটগুলো এখনো “অত্যন্ত চতুর ও ক্ষতিকর” এবং সহজে বন্ধ করা যাচ্ছে না। “এআই নিউডিফায়ারদের বিরুদ্ধে লড়াই এখনো ‘হোয়াক-এ-মোল’ খেলার মতো — একটিকে বন্ধ করলে আরেকটি বেরিয়ে আসে,” বলেছে ইন্ডিকেটর, এই ধরনের অ্যাপ ও সাইটকে তারা “পর্যবেক্ষণ এড়াতে পারদর্শী ও ক্রমাগত আক্রমণাত্মক শত্রু” হিসেবে বর্ণনা করেছে।