আজকাল ওয়েবডেস্ক: সমুদ্রের গভীর থেকে উঠে এসেছে এক বিরল এবং বিস্ময়কর দৃশ্য, যা সামুদ্রিক বিজ্ঞানী মহলে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। প্রথমবারের মতো চিতা হাঙর বা লেপার্ড শার্কের (Stegostoma tigrinum) দলগত প্রজনন প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ চিত্র ধরা পড়েছে ক্যামেরায়। এই গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যটি রেকর্ড করেছেন নিউ ক্যালেডোনিয়ার নুমেয়া থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত অ্যাবর রিফে গবেষক লাসো। এটি সামুদ্রিক প্রাণীর আচরণের এমন এক ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত যা এখনো পর্যন্ত বিজ্ঞানের অজানা অনেক রহস্যের দরজা খুলে দিচ্ছে।
এই আবিষ্কারের বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে জার্নাল অব ইথোলজি-তে। গবেষক লাসো স্নরকেলিং করার সময় লক্ষ্য করেন, একটি স্ত্রী লেপার্ড শার্ক সমুদ্রতলের বালিতে একদম নিস্তব্ধভাবে শুয়ে আছে, আর তাকে দুইটি পুরুষ হাঙর তার পেক্টোরাল ফিন ধরে স্থির করে রেখেছে। প্রায় ৯০ মিনিট ধরে এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এরপর হঠাৎই দুই পুরুষ হাঙর সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং প্রজনন প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রথম মিলন স্থায়ী হয় ৬৩ সেকেন্ড এবং দ্বিতীয়টি ৪৭ সেকেন্ড, অর্থাৎ মোট ১১০ সেকেন্ড। ঘটনাটি শেষ হলে দুই পুরুষ হাঙর ক্লান্ত হয়ে সমুদ্রতলে স্থির হয়ে পড়ে থাকে, আর স্ত্রী হাঙরটি দ্রুত সরে যায় গভীর জলের দিকে।
আরও পড়ুন: সৌরজগতের বাইরে ৬,০০০ গ্রহ আবিষ্কার করেছে নাসা, কী রয়েছে এলিয়েন গ্রহগুলিতে
চিতা হাঙর সাধারণত ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উপকূলীয় জলে বাস করে। পূর্ব আফ্রিকা থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত এই প্রজাতি মূলত প্রবালপ্রাচীর, ম্যানগ্রোভ, সামুদ্রিক ঘাসক্ষেত্র এবং কাদামাটির উপকূলে বসবাস করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বর্তমানে এই প্রজাতি আইইউসিএন রেড লিস্টে বিপন্ন (Endangered) হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। অতিরিক্ত মাছধরা এবং আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পশ্চিম ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এদের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। কিছু স্থানে স্থানীয় জনসংখ্যা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
এই কারণেই এতদিন লেপার্ড শার্ক নিয়ে অধিকাংশ গবেষণা বন্দী বা কৃত্রিম পরিবেশে জন্মানো হাঙরদের উপরই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এবার প্রকৃত পরিবেশে এই আচরণ দেখা যাওয়া এক ঐতিহাসিক অগ্রগতি বলে মনে করছেন গবেষকেরা। অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব দ্য সানশাইন কোস্টের ড. ক্রিস্টিন ডাজন বলেন, “এই প্রমাণ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে নিউ ক্যালেডোনিয়ার এই অংশটি লেপার্ড শার্কের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি ভবিষ্যতে সংরক্ষণ ও জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনার কৌশল নির্ধারণে সহায়ক হবে।”
তিনি আরও বলেন, এই আবিষ্কার শুধু হাঙরের প্রজনন আচরণ সম্পর্কে নতুন জ্ঞান দেয়নি, বরং এটি কৃত্রিম প্রজনন ও পুনর্বাসন গবেষণাতেও ব্যবহার করা যেতে পারে। এ থেকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও উঠে এসেছে—একটি স্ত্রী হাঙরের ডিমে কি একাধিক পুরুষের বীর্য ভূমিকা রাখতে পারে? যদি তাই হয়, তবে এটি প্রজাতির জেনেটিক বৈচিত্র্য বজায় রাখা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এই অনন্য দৃশ্যের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রকৃতির গভীরে এখনও অসংখ্য রহস্য লুকিয়ে আছে, যা মানবজ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে চলেছে এবং আমাদের পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব নতুনভাবে উপলব্ধি করাচ্ছে।
