আজকাল ওয়েবডেস্ক: গত ছয় মাসে পাকিস্তান প্রমাণ করেছে দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি এখন সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। তাঁর নিয়ন্ত্রণ আরও দীর্ঘস্থায়ী করতে পাকিস্তান সরকার এখন যে পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা দেশের রাজনীতিতে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। পাক সরকার আনতে চলেছে ২৭তম সংবিধান সংশোধনী, যা পর্যবেক্ষকদের মতে মূলত মুনিরের ক্ষমতা ও অবস্থান সুরক্ষিত করার জন্যই তৈরি।


এই খবর প্রথম প্রকাশ্যে আসে পিপিপি প্রধান বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারির টুইটের মাধ্যমে। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ তাঁর দলের সমর্থন চাইছেন এই সংশোধনের জন্য। প্রস্তাবিত পরিবর্তনের মধ্যে সংবিধানিক আদালত গঠন ও বিচারকদের বদলি সংক্রান্ত বিষয় থাকলেও, আসল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু সংবিধানের ২৪৩ ধারা।


এই ধারা অনুযায়ী, পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশ ক্ষমতা ফেডারেল সরকারের হাতে থাকে। তবে সংশোধনীর মাধ্যমে এই ধারায় পরিবর্তন আনার প্রস্তাব উঠেছে—যা অনেকের মতে সেনাপ্রধানের ক্ষমতাকে সাংবিধানিকভাবে স্থায়ী ও শক্তিশালী করবে।


শরিফ সরকার বিষয়টি গোপন রাখলেও, বিশ্লেষকরা বলছেন এটি আসলে মুনিরের পদ ও প্রভাব দীর্ঘায়িত করার কৌশল, যা পাকিস্তানের বেসামরিক শাসনের উপর সামরিক প্রভাব আরও বাড়াবে।
পাকিস্তানে সামরিক প্রভাব কোনো নতুন বিষয় নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই দেশটির রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ছায়া বিস্তৃত। এবছর ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাতের পরই মুনিরকে পদোন্নতি দিয়ে ফিল্ড মার্শাল করা হয়—পাকিস্তানের ইতিহাসে দ্বিতীয়বার, প্রথম ছিলেন আয়ুব খান, যিনি নিজেই সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নিজেকে ফিল্ড মার্শাল বানিয়েছিলেন।


গত বছর পাকিস্তান সরকার সেনাপ্রধানদের মেয়াদ তিন বছর থেকে পাঁচ বছরে বাড়ায়, এবং ৬৪ বছরের বয়সসীমাও বাতিল করে। তবে সংবিধানে ফিল্ড মার্শালের পদটির কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই। ফলে মুনিরের ভবিষ্যৎ পদমর্যাদা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। তাঁর অবসর নির্ধারিত নভেম্বর ২৮, অর্থাৎ এখন থেকে কয়েক সপ্তাহ পরেই।


এই প্রেক্ষিতে ২৪৩ ধারা সংশোধনের প্রস্তাবকে অনেকেই মুনিরের জন্য একপ্রকার “পদ রক্ষা আইন” হিসেবে দেখছেন। পাকিস্তানের আইন প্রতিমন্ত্রী আকিল মালিক বলেন, “১৯৭৩ সালের সংবিধান প্রণয়নের পর এই প্রথম কোনো সেনাপ্রধানকে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করা হয়েছে। তাই বিষয়টি সংবিধানে প্রতিফলিত হওয়া দরকার।”


রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপ পাকিস্তানে সামরিক প্রভাবকে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে বৈধতা দেওয়ার প্রচেষ্টা এবং এটি দীর্ঘদিনের নাগরিক-সেনা ক্ষমতার ভারসাম্যকে আরও বিকৃত করবে।


গত কয়েক মাসে মুনির কার্যত পাকিস্তানের “ডি ফ্যাক্টো রাষ্ট্রপ্রধান” হয়ে উঠেছেন। তিনি গত তিন মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিনবার সফর করেছেন, এমনকি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও একাধিক বৈঠক করেছেন—যার একটি হয়েছিল হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজে, যেখানে কোনো বেসামরিক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন না।


এমন নজিরবিহীন ঘটনাই ইঙ্গিত দিচ্ছে, পাকিস্তানে এখন সেনাপ্রধান কেবল প্রতিরক্ষা নয়, বিদেশনীতি ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনাতেও সরাসরি ভূমিকা রাখছেন। ট্রাম্প নিজেও মুনিরকে বলেছেন, “পাকিস্তানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।”


সব মিলিয়ে, সংবিধান সংশোধনের এই পদক্ষেপ পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক কর্তৃত্বকে আরও গভীরভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারে—এবং দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে এক নতুন সংকটের মুখে ফেলতে পারে।