আজকাল ওয়েবডেস্ক: দীর্ঘ রোগভোগের পর বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ৮০ বছর বয়সে জীবনাবসান হয়েছে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টি (বিএনপি) সভাপতি এবং প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি দল আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা বাংলাদেশের দুই মহিলা রাজনীতিবিদের মধ্যে অন্যতম। গত চার দশক ধরে দু’জনে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিলেন। পাঁচ বারের প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই পলাতক। কিন্তু খালেদার পদ্মাপারের মসনদে প্রত্যাবর্তন আর হল না। 

তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন হাসিনা। আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে তিনি লিখেছেন, “বিএনপি চেয়ারপারসন ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে আমি গভীর শোকাহত। বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা, জাতির প্রতি তাঁর অবদান ছিল তাৎপর্যপূর্ণ এবং স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর মৃত্যু বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনের জন্য এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বের জন্য এক গভীর ক্ষতি। আমি বেগম খালেদা জিয়ার আত্মার চির শান্তি কামনা করি। তাঁর পুত্র তারেক রহমান এবং শোকগ্রস্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা।”

শেখ হাসিনা (বাঁ দিকে) এবং খালেদা জিয়া (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।

নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি জিয়া ও হাসিনার তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয়েছে। এই বিরোধ ‘দুই বেগমের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। ‘বেগম’ বাংলাদেশের একজন প্রভাবশালী নারীর জন্য ব্যবহৃত একটি সম্মানসূচক উপাধি। তাঁদের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা নির্বাচনী প্রতিযোগিতার সীমা ছাড়িয়ে দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজপথে হিংসা উস্কে দিয়েছিল, শাসনব্যবস্থাকে অচল করে দিয়েছিল এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে অন্তঃসারশূন্য করে তুলেছিল।

খালেদার সমর্থকরা তাঁকে বিনয়ী ও ঐতিহ্যবাহী এবং একই সঙ্গে একজন রুচিশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখতেন। যিনি ভেবেচিন্তে কথা বলতেন। সমর্থকদের চোখে তিনি তাঁর দলকে রক্ষা এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলার ক্ষেত্রে একজন সাহসী ও আপসহীন নেত্রী ছিলেন। অন্যদিকে, হাসিনা ছিলেন অনেক বেশি স্পষ্টভাষী ও দৃঢ়চেতা।

ঢাকায় খালেদা জিয়ার পুত্র আরাফত রহমান কোকোর বিয়ের অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: ফেসবুক।

দু’জনের মধ্যেকার তিক্ততা শুরু ১৯৭৫ থেকে। ওই বছর পরিবারের অনেক সদস্য-সহ সেনার হাতে খুন হন আওয়ামী লীগের প্রধান বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান। তিন মাস পরে খালেজর স্বামী ডেপুটি সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান দেশের শাসনব্যবস্থা হাতে নেন। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি হন। 

১৯৮১-তে জিয়াউরকে খুন করা হয়। ৩৫ বছর বয়সী খালেদা তখন দুই সন্তানের মা। বিএনপির দায়িত্ব তাঁর কাঁধে বর্তায়। রাজনীতির ময়দানে শিক্ষানবীশ হিসেবে সকলে দাগিয়ে দিলেও, হাসিনার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ১৯৯০ সালে সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা জন্য একটি গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন। কিন্তু খালেদা এবং হাসিনার বন্ধুত্ব টেকেনি বেশিদিন। ১৯৯১ সালে হাসিনাকে টপকে বাংলাদেশের প্রথম অবাধ নির্বাচনে জয় লাভ করেন খালেদা। তাঁকে সমর্থন জুগিয়েছিল বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইসলামিক পার্টি জামাত-ই-ইসলামি। খালেদ হন দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর পরে মুসমিল প্রধান কোনও দেশের দ্বিতীয় মহিলা প্রধান।

তিনি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতি চালু করেন, যাতে ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকে। পরবর্তী দেড় দশক ধরে এই দুই নারী বাংলাদেশে পালাক্রমে ক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে জিয়া হাসিনারের কাছে পরাজিত হলেও, পাঁচ বছর পর তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ফিরে আসেন। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠনের উত্থান এবং দুর্নীতির কারণে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন খালেদা। যদিও সেই সময় তিনি তাঁর দৃঢ়তার জন্য প্রশংসিত হয়েছিলেন। তবে আপস করতে রাজি না হওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েন এবং দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে কোনঠাসা হয়ে যান।

২০০৪ সালে হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়। হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও ২০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হন এবং ৫০০ জনেরও বেশি আহত হন। এই ঘটনার জন্য জিয়া সরকার ও তাঁর ইসলামিক মিত্রদের দায়ী করা হয়েছিল। তাঁদের অমীমাংসিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশ কিছু সঙ্কটের জন্ম দিয়েছিল। যার মধ্যে ছিল ২০০৭ সালের জানুয়ারির অচলাবস্থা। সামরিক জরুরি শাসনের পথে ঠেলে দিয়েছিল বাংলাদেশকে। পরবর্তীতে হাসিনা প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন এবং ২০০৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। হাসিনা ভারতে নির্বাসিত এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিষিদ্ধ। এর ফলে সকলেই ধারণা করেছিলেন যে ২০২৬-এর সাধারণ নির্বাচনের পর খালেদা বাংলাদেশকে শেষবারের মতো নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু তা আর হল না।