আজকাল ওয়েবডেস্ক: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি শাসনের নৃশংসতায় জার্মান পুরুষদের পাশাপাশি এক বিস্ময়কর ভূমিকা নিয়েছিল জার্মান নারীরাও। দীর্ঘদিন ধরে ইতিহাস ও জনপ্রিয় কাহিনিতে এই নারীরা কেবল যুদ্ধের শিকার, পরিবারহারা ও ধর্ষণের শিকার হিসেবে চিত্রিত হয়ে এসেছে। কিন্তু ইতিহাসবিদ ওয়েন্ডি লোয়ার তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, বাস্তব চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। তাঁর বই Hitler’s Furies জানায়, লক্ষাধিক জার্মান নারী সরাসরি বা পরোক্ষভাবে নাৎসি হত্যাযজ্ঞে যুক্ত ছিল, অনেকেই নিজ হাতে নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে।
লোয়ার, যিনি ক্লেয়ারমন্ট ম্যাককেনা কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক এবং ওয়াশিংটন ডি.সি.-র হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়ামের পরামর্শদাতা, বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে নাৎসি যুগের নথি, ডায়েরি, চিঠি এবং যুদ্ধ-পরবর্তী আদালতের দলিল ঘেঁটে এই ভয়াবহ সত্য উন্মোচন করেন। তাঁর অনুসন্ধান বলছে, ১৯৩৯ সালে জার্মানির ৪ কোটি নারীর মধ্যে অন্তত ১ কোটি ৩০ লক্ষ নারী কোনো না কোনো নাৎসি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তাঁদের মধ্যে প্রায় পাঁচ লক্ষ নারীকে পাঠানো হয়েছিল পূর্ব ইউরোপের দখল করা অঞ্চলগুলোয়—ইউক্রেন, পোল্যান্ড, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া প্রভৃতি দেশে—যেখানে ইহুদি গণহত্যা চলছিল দৈনন্দিন কাজের মতো স্বাভাবিকভাবে।
এই নারীরা শুধু প্রশাসনিক কাজেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কেউ ছিল এসএস বা গেস্টাপোর দপ্তরের টাইপিস্ট, কেউ শিক্ষক, নার্স, সমাজকর্মী, আবার কেউ সরাসরি বন্দিশিবিরে প্রহরী বা “সহযোগী হত্যাকারী”। কেউ কেউ আবার তাদের পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে বন্দিদের হত্যা বা নির্যাতনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। ইর্মা গ্রেসে, ইলসে কখ, মারিয়া ম্যান্ডেল, অ্যালিস অর্লভস্কি, দোরোথিয়া বিন্ৎস—এই নামগুলো ইতিহাসে ভয়ঙ্কর প্রতীকে পরিণত হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ বন্দিদের কুকুর দিয়ে ছিঁড়তে দিত, কেউ গ্যাসচেম্বারে শিশুদের ছুঁড়ে ফেলত, কেউ আবার বন্দিদের চামড়া দিয়ে সাজসজ্জার সামগ্রী বানানোর এমনকি পুরুষ কয়েদিদের ধর্ষণ করার অভিযোগে কুখ্যাত হয়।
লোয়ার দেখিয়েছেন, এই নারীদের মধ্যে অনেকেই উচ্চশিক্ষিত বা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছিল, যারা নাৎসি রাষ্ট্রের বর্ণবাদী মতাদর্শে গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল। কেউ নিজের ক্যারিয়ার গড়তে, কেউ কর্তৃত্বের স্বাদ নিতে, কেউ আবার নিছক আনন্দ বা সম্পদ লুটের আশায় এই হিংসায় জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধের সময় পুরুষদের সামরিক ফ্রন্টে পাঠানো হলে, নারীরা পূর্ব ইউরোপে প্রশাসনিক বা দখলকারী ভূমিকায় স্বাধীনতা পায়—আর সেই “স্বাধীনতা”ই অনেকের মধ্যে নিষ্ঠুরতার উন্মাদনা জাগিয়ে তোলে।
কিছু নারী বন্দিশিবিরের পাশে বসে সৈন্যদের জন্য খাবার ও মদ নিয়ে যেত, গুলি চালানো দেখত, উৎসাহ দিত, আবার কেউ কেউ নিজেরাই বন্দিদের উপর গুলি চালাত। বেলারুশের লিদা শহরে কয়েকজন জার্মান নারী শীতের দিনে সৈন্যদের সঙ্গে “শিকার” করতে গিয়ে ইহুদি শ্রমিকদের গুলি করে মেরে ফেলার ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীরা আজও শিউরে ওঠেন। লভিভ শহরে এক কমান্ড্যান্টের স্ত্রী তার বাড়ির বারান্দা থেকে বন্দিদের দিকে গুলি চালিয়ে অতিথিদের “বিনোদন” দিতেন, পাশে থাকত তাঁর ছোট মেয়ে।
নার্সদেরও একটি বড় অংশ নাৎসি নৃশংসতার সহযোগী হয়ে ওঠে। তারা হাসপাতাল ও বন্দিশিবিরে রোগী ও প্রতিবন্ধীদের গোপনে হত্যা করত, শিশুদের গ্যাসচেম্বারে পাঠাত, এবং ভয়ঙ্কর চিকিৎসা পরীক্ষায় সহায়তা করত। স্কুলের শিক্ষিকারা ছোটদের শেখাত “জাতিগত বিশুদ্ধতা”র পাঠ, এবং মানসিক বা শারীরিকভাবে দুর্বল শিশুদের “অযোগ্য” হিসেবে চিহ্নিত করত।
লোয়ার বলেন, নাৎসি নারীরা “পাশাপাশি থাকা দর্শক” ছিল না, বরং সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। তাঁদের অনেকেই বন্দিদের সম্পদ লুট করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়, অন্যদের উপর আধিপত্য বিস্তারে উন্মাদ আনন্দ উপভোগ করে। জার্মান ভাষায় এদের এই মানসিক উন্মাদনাকে বলা হতো Ostrausch—অর্থাৎ “পূর্বের উন্মাদনা”—যা ছিল সহিংসতা ও ভোগবিলাসের এক বিকৃত সংমিশ্রণ।
তবু যুদ্ধের পর এই নারীদের অধিকাংশই ফিরে গিয়েছিল স্বাভাবিক জীবনে। অল্প কয়েকজনকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল; অধিকাংশই আদালতে অস্বীকার করেছে, অপরাধ ঢেকেছে, নিজেকে “ভিকটিম” বলে দাবি করেছে। এমনকি শিশুহত্যাকারী জোহান্না আল্টফাটারও, যিনি গেটোতে শিশুদের মাথা দেয়ালে ঠুকে হত্যা করতেন, ১৯৭৯ সালে জার্মান আদালতে প্রমাণের অভাবে মুক্তি পান এবং ২০০৩ সালে মৃত্যু হয় তার।
ওয়েন্ডি লোয়ারের গবেষণা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানবসভ্যতার অন্ধকারতম অধ্যায়ে নারীও কখনো কখনো পুরুষের মতোই নিষ্ঠুর হতে পারে, এমনকি কখনো তার চেয়েও বেশি। ইতিহাসে পুরুষ অপরাধীদের নাম যতটা পরিচিত, নারীদের ভূমিকা ততটাই আড়ালে থেকে গেছে। কিন্তু “ফিউরারের দাসীরা”—এই নারী হত্যাকারীরা—হিটলারের রক্তাক্ত সাম্রাজ্যকে চালিয়ে নেওয়ার পিছনে যে কত বড় ভূমিকা রেখেছিল, তা এখন ইতিহাসের পাতায় লজ্জাজনকভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
