আজকাল ওয়েবডেস্ক: ইরান এক দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ জলসঙ্কটের মুখোমুখি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে রাজধানী তেহরান খুব শিগগিরই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শহরজুড়ে যখন মানুষ বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করছে, তখন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান কঠোর সতর্কবার্তা দিয়েছেন—ডিসেম্বরে বৃষ্টি না হলে শুধুমাত্র জলের রেশনিং কোনওভাবেই সঙ্কট সামাল দিতে পারবে না। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রেসিডেন্ট বলেন, “আমরা রেশনিং করলেও যদি আর বৃষ্টি না হয়, তাহলে আমাদের হাতে কোনও জল থাকবে না।”
ছয় বছর ধরে টানা খরা, ৪০% কম বৃষ্টি
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ইরানের জলাধারগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টানা ছয় বছর ধরে খরার মধ্যে রয়েছে। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা প্রায় ১২২ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছুঁয়ে যায়। ৫৭ বছরের গড় বৃষ্টিপাতের তুলনায় গত বছর বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ৪০ শতাংশ কম। আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত শুষ্ক আবহাওয়া চলবে।
তেহরানের জলের ওপর নির্ভরতা পাঁচটি রিজার্ভারের ওপর, যেগুলো শহরের বাইরে নদীগুলো থেকে জল পায়। আগে এগুলো মিলিয়ে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনমিটার জল ধারণ করত, এখন সেই পরিমাণ নেমে প্রায় অর্ধেকে, অর্থাৎ মাত্র ২৫০ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে।
জাতীয় মাত্রায় সঙ্কট: ১৯টি বড় বাঁধ শুকিয়ে গেছে
সমস্যা শুধু তেহরানের নয়। দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মাশহাদের জলের মজুত নেমে গেছে ৩ শতাংশেরও নিচে। জাতীয়ভাবে ইরানের প্রায় ১৯টি বড় বাঁধ, যা মোট বাঁধের প্রায় ১০ শতাংশ, পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইজরায়েলের সঙ্গে সাম্প্রতিক ১২ দিনের যুদ্ধ, যা এই অবকাঠামোকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
এক স্থানীয় রেস্তোরাঁ মালিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “বছরের পর বছর ধরে সরকার এই সমস্যার কথা জানত, কিন্তু কিছুই করা হয়নি।” জ্বালানি মন্ত্রী আব্বাস আলিআবাদি জানিয়েছেন, সঙ্কট সামাল দিতে রাতের বেলা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখার মতো কঠোর পদক্ষেপ নিতে হতে পারে।
গবেষকেরা জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করলেও দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাকেও বড় কারণ হিসেবে দেখছেন। ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক গবেষক আমির আগা-কূচক বলেন, “সমস্যার মূলে আছে অব্যবস্থাপনা এবং ব্যবস্থার গভীর দুর্নীতি। ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠানগুলো অনুমতি ছাড়াই বাঁধ ও টানেল নির্মাণ করেছে।”
অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলনের ফলে জমি লবণাক্ত হয়ে পড়ছে এবং বহু হ্রদ শুকিয়ে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে অবৈধ কূপ খনন এবং অদক্ষ কৃষি পদ্ধতির কারণে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়েছে। প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ানও পূর্ববর্তী সরকারগুলোর ওপর দায় চাপিয়েছেন। দক্ষিণ-পশ্চিম খুজেস্তান প্রদেশে জলের সঙ্কটকে কেন্দ্র করে বহুবার বিক্ষোভ হয়েছে, কোথাও কোথাও তা হিংসার রূপ নিয়েছে।
তেহরান সিটি কাউন্সিলের প্রধান মেহেদি চামরান বলেন, “আগে মানুষ মরুভূমিতে গিয়ে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করত। হয়তো এই ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়ার সময় এসেছে।”
সরকার অস্থায়ী সমাধান হিসেবে জল চাপ কমানো এবং রিজার্ভার থেকে অন্য এলাকায় জল সরানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে কর্মকর্তাদের মতে, ডিসেম্বরের মধ্যে বৃষ্টি না হলে ইরানের জলসঙ্কট ভয়াবহ রূপ নেবে—যা এড়ানোর উপায় প্রায় নেই।
