আজকাল ওয়েবডেস্ক: চীনে নাকি পার্টি সদস্যরা একে অপরকে ''কমরেড'' বলে সম্বোধন করছে না। এই নতুন প্রবণতায় কিঞ্চিৎ মাথায় হাত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির। কমরেডের বদলে 'বস' বা 'স্যার' বলে সম্বোধনের প্রবণতা বাড়ছে সেই জন্য নতুন নির্দেশিকাও জারি করেছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি। সদস্যদের আবারও একে অপরকে সম্বোধন করতে হবে একটি পুরনো, কিন্তু ঐতিহ্যবাহী শব্দে— ‘কমরেড’ (তুংঝি)। পার্টির শীর্ষ নেতৃত্বের নতুন নির্দেশিকা অনুযায়ী, ভবিষ্যতে আর ‘বস’, ‘ব্রো’ বা অন্য কোনো আধুনিক সম্বোধন ব্যবহার করা যাবে না। পার্টির শৃঙ্খলা রক্ষার অংশ হিসেবে গৃহীত এই সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, “কমরেড” সম্বোধন পুনরুজ্জীবিত করলে সদস্যদের মধ্যে সমতা, সংহতি এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার পরিবেশ তৈরি হবে। পার্টির সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, এই সম্বোধন কমিউনিস্ট আদর্শ ও বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করবে।
ইতিহাসের ধারা অনুযায়ী ‘কমরেড’ ডাক চীনে নতুন নয়। কিন সাম্রাজ্যের (খ্রিস্টপূর্ব ২২১–২০৬) সময় থেকেই শব্দটি প্রচলিত। তবে প্রকৃত অর্থে এর বিপ্লবী মর্যাদা তৈরি হয় ১৯২১ সালের কমিউনিস্ট বিপ্লবের সময়। মাও সেতুং-এর নেতৃত্বাধীন যুগে ‘তুংঝি’ সম্বোধন ছিল দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ। মাও আমলে শ্রেণি-বৈষম্যমূলক ‘স্যার’, ‘মিস্টার’ প্রভৃতি সম্বোধনকে পুরনো সমাজের “অবক্ষয়ী চর্চা” বলে ঘোষণা করে ‘কমরেড’কেই সর্বজনীন রূপ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মাও-পরবর্তী সংস্কারপন্থী যুগে (১৯৭৮-এর পর) বাজার অর্থনীতির প্রসারে এই শব্দটি ধীরে ধীরে আড়ালে চলে যায়। তার জায়গা নেয় আধুনিক শব্দ যেমন— সিয়ানশেং (মিস্টার), মেইনু (সুন্দরী নারী), লাওবান (বস)।
সমকামী সমাজেরও অবদান এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৮০–র দশকের শেষের দিকে শব্দটি নতুন অর্থ পায়। হংকংয়ের প্রথম লেসবিয়ান ও গে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে (১৯৮৯) সমকামী কর্মীরা ‘তুংঝি’ শব্দটিকে নিজেদের পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেন। তুংশিংলিয়ান, অর্থাৎ “সমকামী”, যা চিকিৎসাবিদ্যায় একসময় রোগ হিসেবে চিহ্নিত হত, তার পরিবর্তে ‘তুংঝি’ অর্থ দাঁড়ায় “একই উদ্দেশ্য, একই ইচ্ছা”। এভাবে শব্দটি লিঙ্গনিরপেক্ষ, ইতিবাচক ও মর্যাদাপূর্ণ বিকল্প হয়ে ওঠে। আজও মূল ভূখণ্ড চীন, হংকং ও তাইওয়ানে LGBTQ সম্প্রদায় ব্যাপকভাবে এই সম্বোধন ব্যবহার করে থাকে।
তবে বর্তমান দ্বন্দ্ব এক ভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। চীনের সাধারণ মানুষদের কাছে এখন ‘কমরেড’ শব্দটির এক দ্বৈত অর্থ রয়েছে— একদিকে এটি কমিউনিস্ট পার্টির ঐতিহ্যবাহী সম্বোধন, অন্যদিকে LGBTQ সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক কোড। ফলে পার্টির নতুন নির্দেশ কার্যকর হলে মজার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যেখানে একজন প্রবীণ নেতা সমতা বোঝাতে ‘কমরেড’ ডাকছেন, আর তরুণ প্রজন্মের কেউ সেটিকে অন্য অর্থে গ্রহণ করছেন।
প্রজন্মগত বিভাজনও লুকিয়ে আছে এর অন্তরালে। ভাষাতত্ত্ববিদ লুকাস ক্লেইন জানান, ষাট–সত্তরের দশকের মানুষরা আজও নারী ও পুরুষকে ‘নান তুংঝি’ (পুরুষ কমরেড) ও ‘নু তুংঝি’ (নারী কমরেড) বলে সম্বোধন করেন, অনেক সময় তারা LGBTQ অর্থটি জানেনই না। অন্যদিকে তরুণ সমাজে এটি গোপন সংকেত বা রসিকতার কারণ হয়ে ওঠে।
এই পরিস্থিতিতে পার্টির উদ্দেশ্য হল দক্ষিণ গুয়াংডং প্রদেশে সম্প্রতি পার্টির শৃঙ্খলা কমিশন এক নির্দেশে জানিয়েছিল, সদস্যরা একে অপরকে “বস” বা “ব্রো” বলে ডাকতে পারবেন না, কারণ এতে গণসেবকের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় এবং গণতান্ত্রিক চর্চা ব্যাহত হয়। নতুন কেন্দ্রীয় নির্দেশ তারই সম্প্রসারিত রূপ। পার্টির মতে, ‘কমরেড’ ডাক ফিরিয়ে আনা মানে পুরনো বিপ্লবী ঐতিহ্য ও সমতার ভিত্তিতে নতুন প্রজন্মকে শৃঙ্খলার পথে ফেরানো। চীনে এখন প্রশ্ন একটাই: রাজনৈতিক মঞ্চে যে ডাক বিপ্লবের ঐতিহ্য বহন করে, সেটিই আজ সাংস্কৃতিক দ্ব্যর্থবোধকতার কারণ হয়ে উঠেছে। ‘কমরেড’ কি পার্টির শৃঙ্খলার প্রতীক হয়ে ফিরে আসবে, নাকি এটি থেকে যাবে এক সাংস্কৃতিক ও প্রজন্মগত বিভ্রান্তির উৎস?
