আজকাল ওয়েবডেস্ক: ২০২৫ সালের অর্থনীতির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ফিলিপ আগিয়ন, পিটার হাওইট এবং জোয়েল মকির। এমন এক সময়ে এই ঘোষণা হল, যখন বিশ্ব অর্থনীতি বিশেষত উদীয়মান দেশগুলোর সামনে বৃদ্ধির ভবিষ্যৎ পথ নিয়ে অনিশ্চয়তা প্রকট। বিশ্বজুড়ে অর্থনীতি বিস্তৃত হওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত, কিন্তু সামগ্রিক উৎপাদনশীলতার গতি মন্থর। প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত অগ্রসর হচ্ছে—উৎপাদন প্রক্রিয়া হচ্ছে আরও মূলধননির্ভর, কিন্তু শ্রমজীবী শ্রেণির আয়ের স্থিতি ও নিরাপত্তা ক্রমেই নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। এই বৈপরীত্যের ব্যাখ্যা দিচ্ছে এবারের নোবেলজয়ীদের গবেষণা।

তাঁরা দেখিয়েছেন, উদ্ভাবন একটানা শান্তিপূর্ণ অগ্রগতির প্রক্রিয়া নয়, বরং তা এক অনবরত উদ্ভাবন ও ধ্বংসের মাধ্যমে গঠিত এক সংগ্রামী যাত্রা। অগ্রগতির প্রকৃত চালিকাশক্তি হলো “সৃষ্টিশীল ধ্বংস” (creative destruction)—এক প্রক্রিয়া যেখানে পুরনো প্রযুক্তি ও প্রতিষ্ঠান ভেঙে নতুনের জন্ম হয়।

অর্থনৈতিক তত্ত্বে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

আগিয়ন ও হাওইট তাঁদের “কোয়ালিটি ল্যাডার” (quality ladder) মডেলের মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন, বৃদ্ধি আসে প্রতিযোগিতা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগত উন্নতির চেষ্টা করে, কারণ প্রত্যেকটি নতুন সাফল্য আগের নেতাকে মাটিতে নামিয়ে আনে। তাই অর্থনৈতিক বৃদ্ধি কোনও সাধারণ উত্থান নয়, বরং ধাক্কা ও পরিবর্তনের সমষ্টি।

আরও পড়ুন: সঙ্গীতশিল্পীদের মাথায় হাত, ভয় দেখাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কীভাবে

অন্যদিকে, ইতিহাসবিদ জোয়েল মকির দেখিয়েছেন যে “উদ্ভাবনের সংস্কৃতি” (culture of growth) গড়ে ওঠে এমন সমাজে যেখানে কৌতূহল, মতভেদ ও প্রশ্ন করার স্বাধীনতা বিদ্যমান। যে সমাজ চিন্তার স্বাধীনতাকে মূল্য দেয়, সেই সমাজই বড়ো উদ্ভাবনের জন্ম দেয়। আজকের তথ্যনির্ভর যুগে, যেখানে অ্যালগরিদম আচরণ নির্ধারণ করছে, সেখানে এই মত স্বাধীনতার প্রয়োজন আরও বেশি।

উদ্ভাবন বনাম কর্মসংস্থান

বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই ধারণাগুলি আরও তাৎপর্যপূর্ণ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) বিশ্ব অর্থনীতির প্রতিযোগিতার নিয়মই পাল্টে দিচ্ছে। ২০২৪ সালের আইএমএফ রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪০% চাকরি অটোমেশনের ঝুঁকিতে রয়েছে। আগের প্রযুক্তি বিপ্লবগুলির মতো নয়, এবার হুমকি শুধু উৎপাদন ক্ষেত্রেই নয়, জ্ঞানভিত্তিক ও সেবা খাতেও।

এটি বিশেষ করে উদ্বেগজনক ভারতের মতো দেশে, যেখানে প্রায় ৮০% কর্মসংস্থান অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে এবং প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। যদি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করে, তবে “সৃষ্টিশীল ধ্বংস” কেবল “ধ্বংস” হয়ে দাঁড়াবে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন

একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির কাঠামোও বদলাচ্ছে। সরবরাহ শৃঙ্খল (global value chains) এখন ভেঙে পুনর্গঠিত হচ্ছে। ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং নিরাপদ উৎপাদন ব্যবস্থার প্রয়োজনে, উৎপাদন এখন উপভোক্তা বাজারের কাছাকাছি চলে আসছে। ফলে কম খরচে শ্রমনির্ভর উৎপাদনের পুরনো মডেল টিকছে না। উদীয়মান দেশগুলোকে এখন শুধু কী তৈরি করবে তা নয়, কেমনভাবে প্রতিযোগিতা করবে, সেটাও নতুন করে ভাবতে হবে।

নীতিনির্ধারকদের জন্য শিক্ষা

নোবেলজয়ীদের কাজ দেখায় যে উদ্ভাবনের জন্য মুক্ত প্রতিযোগিতা অপরিহার্য। একচেটিয়া বাজার বা রক্ষণশীল নীতির ছায়ায় উদ্ভাবন টিকতে পারে না। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাই পুরনো “ইম্পোর্ট সাবস্টিটিউশন” বা “স্টেট্ চ্যাম্পিয়ন” নীতির বাইরে এসে উন্মুক্ত, প্রতিযোগিতামূলক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে।

আগিয়নের “দূরত্ব তত্ত্ব” (distance to the technological frontier) বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, যেসব দেশ প্রযুক্তিগত সীমার কাছাকাছি, তাদের উচিত নতুন উদ্ভাবনে জোর দেওয়া। আর যেসব দেশ সেই সীমা থেকে দূরে, তাদের উচিত বিদ্যমান প্রযুক্তি গ্রহণ ও উন্নয়নে মনোযোগ দেওয়া। রাষ্ট্রের ভূমিকা এখানে নিয়ন্ত্রকের নয়, বরং সহায়ক।

সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায্য রূপান্তর

তবে উদ্ভাবন নিজে থেকেই বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে। তাই শক্তিশালী সামাজিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া উদ্ভাবনের সুফল সমাজে সুষমভাবে বণ্টিত হয় না। এই কারণেই ইউরোপের “ফ্লেক্সিকিউরিটি” (flexicurity) মডেলকে উদাহরণ হিসেবে ধরা হচ্ছে—যেখানে শ্রমবাজার নমনীয়, কিন্তু কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত।

ভারতের মতো দেশে ডিজিটাল পরিকাঠামো এই রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। আধার ও ইউপিআই-ভিত্তিক ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকারি সুবিধা সরাসরি নাগরিকদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে, যা পরিবর্তনের সময় নিরাপত্তার পরিধি বাড়ায়। কিন্তু কেবল প্রযুক্তি নয়, শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারও জরুরি। এখন এক জীবনের জন্য শেখা দক্ষতা টেকে না। ম্যাকিন্সির হিসাব অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০০ মিলিয়ন শ্রমিককে নতুন পেশায় যেতে হতে পারে।

নোবেল পুরস্কারের তাৎপর্য

এই নোবেল পুরস্কার তাই শুধু অতীতের তত্ত্বকে সম্মান জানায় না, বরং ভবিষ্যতের পথও দেখায়। আমরা এমন এক যুগে প্রবেশ করছি, যেখানে উদ্ভাবনের গতি বেড়েছে, কিন্তু অন্তর্ভুক্তি কমেছে; সমাজ স্থিতি চায়, কিন্তু অগ্রগতির জন্য পরিবর্তন অপরিহার্য।

আগিয়ন, হাওইট ও মকিরের কাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—প্রযুক্তি একা বৃদ্ধি আনতে পারে না। তার জন্য দরকার সঠিক নীতি, উন্মুক্ত সংস্কৃতি এবং পরিবর্তনকে সামলানোর সাহস। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বার্তাটি স্পষ্ট: এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে যা সৃষ্টিশীল শক্তিকে মুক্ত করবে, আবার তার সামাজিক ব্যয়ও সামলাবে।

উদ্ভাবন ভাগ্যের বিষয় নয়—এটি পরিকল্পনার ফল। সমাজকে টিকিয়ে রাখতে হলে বারবার নতুন করে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। এই নোবেল পুরস্কার সেই প্রক্রিয়ারই এক গুরুত্বপূর্ণ দিশারি।