গোপাল সাহা

আফ্রিকার ধুলোময় মাটির নীচে লুকিয়ে ছিল এক অবিশ্বাস্য গল্প। ১৫ লক্ষ বছর আগের এক প্রাণীর জীবাশ্ম, যার হাতের গঠন মানুষের মতোই শক্তিশালী! এই প্রাণীটি কি সত্যিই পাথর কেটে অস্ত্র বানাতে পারত? বিজ্ঞানীরা হতভম্ব। প্রচলিত ধারণা ভেঙে পড়ল নতুন জীবাশ্মের আলোকে।

অনুমান করা যায়, ১৩-১৪ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকার বিস্তীর্ণ মরুভূমি এবং জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত ‘প্যারানথ্রোপাস বোয়েসি’ নামের এক অদ্ভুত প্রাণী। বানর আর মানুষের মাঝামাঝি, কিন্তু এরা সরাসরি আমাদের পূর্বপুরুষ নয়। এরা শক্ত খাবার চিবিয়ে খেত। ‘নাটক্র্যাকার ম্যান’ বলে পরিচিত ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের শরীরের রহস্য ছিল অন্ধকারে মোড়া। সেই অন্ধকার কেটেছে কেনিয়ার তুর্কানা হ্রদের পূর্ব প্রান্তে কুবি ফোরা থেকে খুঁজে পাওয়া এক প্রাচীন কঙ্কালের অংশ দিয়ে।

নাইরোবি থেকে মাত্র ৫১৫ কিলোমিটার দূরে এই আবিষ্কার। বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয়েছে যে, এটি ১৫ লক্ষ বছরের পুরনো ‘প্যারানথ্রোপাস বোয়েসি’রই! মাথার খুলি, দাঁত পুরনো নমুনার সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু আসল ধাক্কা আসে হাত আর পায়ের হাড় পরীক্ষা করতে গিয়ে। সেগুলি পুরনো নমুনার সঙ্গে মিলছে না। প্রথমবার পাওয়া গিয়েছে এমন নমুনা। এর ফলে বিজ্ঞানীরা নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন।

আরও পড়ুন: ট্রাম্পের ‘ক্ষমা’ পেয়ে ‘গভীরভাবে কৃতজ্ঞ’ ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ বিনান্সের প্রতিষ্ঠাতা, কে এই চ্যাংপেং ঝাও

হাতের আঙুল পর্যবেক্ষণ করে দেখা গিয়েছে, বুড়ো আঙুল লম্বা, কনিষ্ঠা সামান্য বাঁকা, বাকি সোজা! এমন গঠন যেন পাথরের হাতুড়ি শক্ত করে ধরার জন্যই তৈরি। আধুনিক মানুষের মতোই! গোরিলার মতো চওড়া হাড়ের সঙ্গে মিল থাকলেও, এরা জিনিস আঁকড়ে ধরতে পারত দারুণভাবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই হাত দিয়ে তারা নিশ্চয়ই পাথরের টুকরো কেটে অস্ত্র বানাতে পারত। কিন্তু প্রমাণ? এখনও নেই তবে সম্ভাবনা প্রচুর!

সম্প্রতি বিশ্ববিখ্যাত ‘নেচার’ জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণার দলের নেতা নিউইয়র্কের স্টনি ব্রুক ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ক্যারি মঙ্গেল বলেন, “এই প্রথমবার আমরা ‘প্যারানথ্রোপাস বোয়েসি’র হাত এবং পায়ের গঠন নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারলাম। এটি বিবর্তনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়!” 

জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ট্রেসি কিভেল যোগ করেন, “হাতের এই গঠন অবাক করার মতো! ‘হোমিনিন’দের মধ্যে গোরিলার সঙ্গে এত মিল? এখন হাতের ব্যবহার নিয়ে গবেষণা পাবে নতুন দিকনির্দেশনা।”

প্রচলিত ধারণা ছিল, পাথরের অস্ত্র তৈরির কৌশল শুধু ‘হোমো’ গণের (যেমন হোমো হ্যাবিলিস, হোমো ইরেক্টাস) একচেটিয়া। কিন্তু ওই যুগে আফ্রিকায় এই ‘প্যারানথ্রোপাস’রাও ছিল! নতুন জীবাশ্ম সেই একচেটিয়া ধারণা ভাঙছে। মঙ্গেল বলেন, “এদের হাত দেখে মনে হয়, তারাও পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করতে পারত। তবে নিশ্চিত হতে আরও প্রমাণ দরকার। যেমন অস্ত্রসহ জীবাশ্ম বা এদের বাসস্থান থেকে আরও অস্ত্রশস্ত্র।”

আধুনিক মানুষের সবচেয়ে প্রাচীন জীবাশ্ম মাত্র ৩ লক্ষ বছরের, কিন্তু এই আবিষ্কার বিবর্তনের গল্পকে আরও জটিল করে তুলেছে। কে জানে, হয়তো আমাদের পূর্বপুরুষদের পাশাপাশি এই ‘নাটক্র্যাকার’রাও ছিলেন শিকারি-শিল্পী! বিজ্ঞানীরা এখন খুঁজছেন আরও সূত্র। আপনার মনে কী ভাবনা এল এই রহস্য নিয়ে?