আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারকে সাধারণত “সুশাসনবাবু” নামে ডাকা হয়। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সততা ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ছিল এক অনন্য দৃষ্টান্ত। কিন্তু সাম্প্রতিক অনুসন্ধান সেই ভাবমূর্তিতে বড় প্রশ্নচিহ্ন তুলেছে। প্রকাশ্যে এসেছে, নীতীশ কুমারের একমাত্র পুত্র নিশান্ত কুমারকে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছেন জনতা দল (ইউ)-এর প্রবীণ নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজীব রঞ্জন ওরফে লালন সিং।

উপহার হিসেবে দেওয়া এই বাড়িটি পাটনার বেইলি রোড সংলগ্ন অভিজাত এলাকায় অবস্থিত শিব রাধিকা কমপ্লেক্সের সর্বোচ্চ তলায়। পেন্টহাউস আকৃতির এই ফ্ল্যাটের দলিল ২০২৪ সালের ১৫ জানুয়ারি রেজিস্ট্রি  হয়, লোকসভা নির্বাচনের মাত্র তিন মাস আগে। সেই সময় লালন সিং মুঙ্গের থেকে লোকসভা সাংসদ ছিলেন এবং নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তিনি নীতীশ কুমারের দলের কোটা থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় জায়গা পান। এটি তাঁর প্রথম কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব।

দলিলে উল্লেখ রয়েছে যে, লালন সিং “শৈশবকাল থেকেই নিশান্তের প্রতি গভীর স্নেহ ও ভালোবাসা পোষণ করেন।” দলিলের ভাষায়, “নিশান্তের আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে” তিনি এই সম্পত্তি উপহার হিসেবে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

তবে সময়কাল ও সম্পত্তির পরিমাণই এখন রাজনৈতিক মহলে জল্পনার কেন্দ্রে। এই উপহার দেওয়ার প্রায় ৫০ দিন পর, অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৪ মার্চ, বিহার বিধান পরিষদ নির্বাচনের আগে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার তাঁর সম্পদের হলফনামা জমা দেন। সেখানে তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৬৪.৮২ লক্ষ টাকা— যার মধ্যে ১.৪৮ কোটি অস্থাবর সম্পত্তি এবং ১৬.৮২ লক্ষ টাকার স্থাবর সম্পত্তি। তাঁর বাৎসরিক আয় (২০২২-২৩ অর্থবছরে) দেখানো হয়েছে মাত্র ৪.৯২ লক্ষ টাকা।

রেকর্ড অনুসারে, লালন সিং ২০২০ সালে ববিতা সিং নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ফ্ল্যাট নম্বর ৫০১ ক্রয় করেছিলেন। ২০১৫ সালে সেই ফ্ল্যাটটি নির্মাতা সঞ্জয় কুমার সিনহার স্ত্রী ববিতা সিং-এর নামে বিক্রি করা হয়। সঞ্জয় সিনহা হলেন নুতন কনস্ট্রাকশন সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর, যে সংস্থা শিব রাধিকা কমপ্লেক্সের নির্মাণের দায়িত্বে ছিল।

শিব রাধিকা কমপ্লেক্স পাটনার শাস্ত্রীনগরে অবস্থিত। ফ্ল্যাটটি ২,১৬০ বর্গফুটের “সুপার বিল্ট-আপ” এরিয়া বিশিষ্ট। দলিল অনুযায়ী এর আনুমানিক মূল্য প্রায় ৯১ লক্ষ টাকা, যদিও স্থানীয় নির্মাতারা দাবি করেছেন, বাজারমূল্য অন্তত দ্বিগুণ। একজন স্থানীয় নির্মাতা বলেছেন, “এই এলাকার ফ্ল্যাট প্রতি বর্গফুটে ৮,০০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। নুতন কনস্ট্রাকশনের ফ্ল্যাটের দাম পাটনায় তুলনামূলক বেশি।”

ভবনটি পরিদর্শন করলে ভবনের প্রহরী জানান, “এই কমপ্লেক্সে একেকটি ফ্ল্যাটের দাম ১.৭ কোটি টাকার আশেপাশে। নিশান্তবাবুর ফ্ল্যাটটি শীর্ষতলায়, একে সবাই পেন্টহাউস বলে।”

দলিল অনুযায়ী, লালন সিং ফ্ল্যাটটির পূর্ণ মালিক ছিলেন এবং তিনি কোনো অর্থ লেনদেন ছাড়াই সম্পত্তিটি নিশান্তের নামে করে দেন। দলিলে লেখা আছে, “ভালোবাসা ও স্নেহের নিদর্শন হিসেবে আমি এই সম্পত্তি নিশান্ত কুমারকে দান করছি এবং এর ওপর আমার আর কোনো অধিকার থাকল না।”

এই ফ্ল্যাটের সঙ্গে নিশান্তকে দেওয়া হয়েছে ছাদ ও সংলগ্ন ৮০০ বর্গফুটের খোলা টেরেসের একচ্ছত্র ব্যবহারাধিকার। রয়েছে দুটি গাড়ি পার্কিং স্পেস এবং নিচতলায় ৫০ বর্গফুটের একটি সার্ভেন্ট রুম। সম্পত্তির মোট জমির পরিমাণ ৩১.২৫ ডিসিমল (প্রায় ১০ কাঠা), যার মধ্যে নিশান্তের ভাগ প্রায় ৭০০ বর্গফুট।

শিব রাধিকা কমপ্লেক্সে বসবাস করেন বহু উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। ভবনটির আশেপাশেই রয়েছে বিহার পুলিশ সদর দপ্তর  ও জেডি উইমেনস কলেজ। এলাকায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জগন্নাথ মিশ্র ও একাধিক সরকারি সচিবের আবাসস্থলও অবস্থিত। প্রহরীর ভাষায়, “নিশান্তবাবু মাঝে মাঝেই এখানে আসেন। নীতীশজিও চার-পাঁচ বার এসেছেন। প্রায় এক বছর আগে গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন।”

এই বিলাসবহুল উপহারের খবরে নীতীশ কুমারের “সৎ রাজনীতিক” ভাবমূর্তিতে বড় ধাক্কা লেগেছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।

লালন সিং, লালু যাদব ও নীতীশ কুমার— তিনজনেই ১৯৭৪ সালের জয়প্রকাশ নারায়ণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। লালন সিং বহুবার মুঙ্গের থেকে সাংসদ হয়েছেন, একবার রাজ্যসভাতেও নির্বাচিত হন। ২০২১ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত তিনি ছিলেন জেডিইউ-র জাতীয় সভাপতি। ২০২৪ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় প্রথমবার স্থান পান এবং বর্তমানে তিনি পঞ্চায়তি রাজ, মৎস্য ও দুগ্ধ উন্নয়ন মন্ত্রকের দায়িত্বে রয়েছেন।

মুঙ্গেরের কল্যাণপুর পঞ্চায়েতের নেতা অশোক জানান, “মন্ত্রী হওয়ার পর লালন সিংকে এলাকায় কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ করতে দেখা যায়নি। তাঁর দপ্তর সংক্রান্ত বড় কোনো প্রকল্পও এখানে হয়নি।”

নীতীশ কুমারের একমাত্র সন্তান নিশান্ত কুমার রাজনীতিতে সক্রিয় নন। তিনি বিট মেশরা (রাঁচি) থেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক এবং একান্ত গোপন জীবনযাপন করেন। নীতীশ কুমার নিজেও বহুবার বলেছেন, তাঁর ছেলে রাজনীতিতে আসবেন না। তবে জেডিইউ-র জাতীয় মুখপাত্র নীরজ কুমারের ভাষায়, “নিশান্ত শিক্ষিত ও যোগ্য। দলের কর্মীরা চান তিনি রাজনীতিতে আসুন, কিন্তু সিদ্ধান্ত তাঁর নিজের।”

সাংবাদিকেরা নিশান্তের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১ আনে মার্গে গিয়ে প্রশ্নপত্র জমা দেওয়া হলেও, এখনো পর্যন্ত নীতীশ বা নিশান্ত কুমারের তরফে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। এই ঘটনাকে ঘিরে বিহারের রাজনীতিতে তীব্র আলোড়ন শুরু হয়েছে। বহুজনের মতে, “সুশাসনবাবু”-র ভাবমূর্তি এখন কঠিন পরীক্ষার মুখে।