আজকাল ওয়েবডেস্ক: দেশে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার নতুন পর্ব শুরু হলো। ইলেকট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, বহুল আলোচিত ডিজিটাল পার্সোনাল ডাটা প্রোটেকশন (ডিপিডিপি) আইন, ২০২৫–এর অধীনে প্রথম দফার নিয়মগুলি তৎক্ষণাৎ কার্যকর করেছে। প্রশাসনিক দিকের এসব নিয়ম এখনই কার্যকর হলেও আগামী ১৮ মাস ধরে ধাপে ধাপে অন্যান্য নিয়মও প্রয়োগ করা হবে।
আইনটি কাগজে-কলমে ভারতের প্রথম পূর্ণাঙ্গ গোপনীয়তা রক্ষার আইন। এর ফলে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলিকে ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্পষ্ট সম্মতি নিতে বাধ্য করা হয়েছে। ব্যক্তির নিজের তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়বে এবং প্রয়োজনে তথ্য মুছে ফেলার অধিকারও নিশ্চিত হবে। আইন বাস্তবায়নের জন্য কোম্পানিগুলিকে নিজেদের ডেটা ব্যবস্থাপনার মান উন্নত করতে কিছুটা সময় দেওয়া হয়েছে।
কী কী নিয়ম এখনই কার্যকর হলো
১৪ নভেম্বর থেকে সরকার যে নিয়মগুলি জারি করেছে, তার মধ্যে রয়েছে—
ডেটা প্রোটেকশন বোর্ড গঠন,
বোর্ডের সদস্যদের বেতন ও চাকরির শর্ত নির্ধারণ।
যেসব বিধান কোম্পানিগুলির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে— যেমন কীভাবে তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ব্যবহার ও মুছে ফেলা হবে— তা এক বছর পরে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে।
প্ল্যাটফর্মগুলির ওপর বাড়তি চাপ
ডিপিডিপি আইনের আওতায় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলিকে এখন থেকে ব্যবহারকারীদের স্পষ্ট নোটিস দিতে হবে, তথ্য ফাঁস হলে তা জানাতে হবে, এবং সীমিত পরিমাণ তথ্য রাখার নিয়ম মানতে হবে। ডেটা ফিডিউশিয়ারি বা তথ্য রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলিকে কঠিন মানদণ্ড অনুযায়ী কাজ করতে হবে।
বিশেষ করে শিশুদের তথ্য ব্যবহার নিয়ে আরও সতর্কতা ও কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে। শিশুদের ব্যক্তিগত তথ্য প্ল্যাটফর্মে প্রকাশের আগে কঠোর যাচাই ও অনুমতির প্রয়োজন হবে।
আইনে ব্যক্তিগত তথ্য বলতে এমন সব তথ্য বোঝানো হয়েছে যা দিয়ে কোনো ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা যায়— সরাসরি নাম বা ঠিকানা না থাকলেও যেকোনো পরোক্ষ তথ্যও এর মধ্যে পড়ে।
তথ্য অধিকার ও সাংবাদিকতার ওপর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ
আইনটি দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় থাকলেও এর বাস্তবায়ন বারবার পিছিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের আপত্তির জেরে নতুন নিয়ম প্রকাশ দেরি হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম বিতর্কিত বিষয় হলো সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে কোনও বিশেষ ছাড় না থাকা। বিশ্বব্যাপী বেশিরভাগ গোপনীয়তা আইনে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমকে ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট’ প্রতিবেদনের জন্য ছাড় দেওয়া হয়। ডিপিডিপি আইনের প্রথম খসড়ায় এমন ছাড় থাকলেও চূড়ান্ত নিয়মে তা বাদ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে—
অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নাম, পদবি বা পদ উল্লেখ করতে পারবেন না, কোনও ব্যক্তির সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হলে আগে তার সম্মতি নিতে হবে, যা সরাসরি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথে বাধা তৈরি করবে। এছাড়া, প্রতি লঙ্ঘনে ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান অনেকের মতে সংবাদমাধ্যমকে ভয় দেখিয়ে চুপ করানোর উপায় হয়ে উঠতে পারে।
আইনটি তথ্যের অধিকারকেও চ্যালেঞ্জ করছে বলে মত প্রকাশ করেছেন বহু অধিকারকর্মী। ডিপিডিপি আইন আরটিআই আইনের ৮(১)(j) ধারা—যেখানে জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশের অনুমতি ছিল—তাকে কার্যত নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে। এতে জনজবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
অধিকারকর্মীরা আরও বলছেন, ‘ডেটা ফিডিউশিয়ারি’ শব্দটির সংজ্ঞা এত বিস্তৃত করা হয়েছে যে সাংবাদিক, শিক্ষক, এমনকি সাধারণ মানুষও এই আইনের আওতায় দায়ী হয়ে পড়তে পারেন। যাদের গোপনীয়তা রক্ষার পরিকাঠামো নেই, তারাও এই আইনের নিয়ম মানতে বাধ্য হবেন।
ডিপিডিপি আইন ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষায় ভারতের এক নতুন অধ্যায় শুরু করল। তবে একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, জনস্বার্থে তথ্য প্রচার এবং নাগরিকদের তথ্যের অধিকার নিয়ে গুরুতর বিতর্ক তৈরি হলো। আগামী ১৮ মাসের ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন এই আইন কতটা কার্যকর হবে এবং কতটা স্বাধীনতা সীমিত করবে— তা সময়ই বলে দেবে।
