আজকাল ওয়েবডেস্ক: নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে আলোচনা চলাকালীন এক বিতর্কে হঠাৎই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে লোকসভা। ঠিক কী নিয়ে চলছিল বিতর্ক? যখন বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী বিজেপি–আরএসএস আঁতাতের বিরুদ্ধে “প্রতিষ্ঠান দখল” ও “ভোট চুরি”র গুরুতর অভিযোগে সরব হন। তিনি বলেন, ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো আজ এক গভীর সাংবিধানিক সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এবং এর কেন্দ্রে রয়েছে ভোটের কারচুপি। তাঁর বক্তব্যে বারবার উঠে আসে, ভারতের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হল ভোটাধিকার, আর সেই ভিত্তিকেই কার্যত নষ্ট করা হচ্ছে পরিকল্পনা করে।

রাহুল অভিযোগ করেন, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে শাসক দল আঁতাত করে দেশজুড়ে ভোটের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করছে। “ভারত শুধু বৃহত্তম নয়, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গণতন্ত্র,” রাহুল বলেন। “আর সেই শ্রেষ্ঠ গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছে বিজেপি এবং নির্বাচন কমিশন। মানুষের কথা বলার অধিকার  কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।” হরিয়ানার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এক ব্রাজিলিয়ান মডেলের নাম ভোটার তালিকায় ২২ বার, আর একজন ভোটারের নাম ২০০ বারের বেশি পাওয়া গেছে—এগুলি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি সুসংগঠিত পরিকল্পনা। একইভাবে বিহারে বিশেষ ভোটার তালিকা সংশোধনের পরও ১.২ লক্ষ ভুয়ো ছবি উদ্ধার হওয়াকে তিনি প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেন। তাঁর বক্তব্য, যদি ভোটার তালিকা সংশোধন  করা হয়েই থাকে, তবে এত জালি নাম-ছবি তালিকায় থেকে গেল কীভাবে? মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও মহারাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফলও জনগণের প্রকৃত মতামতের ফলাফল নয় বলেই তিনি অভিযোগ করেন।

কেন্দ্রকে তিনটি সরাসরি প্রশ্ন করেন রাহুল। প্রথমত, প্রধান বিচারপতিকে কেন সরানো হল নির্বাচন কমিশনার বাছাই কমিটি থেকে? তাঁর অভিযোগ, প্রধান বিচারপতিকে সরিয়ে দেওয়ার ফলে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই কার্যকর হবে। বিরোধীদের মতামত এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, ২০২৩ সালের সংশোধনীতে নির্বাচন কমিশনারদের যে ব্যাপক ছাড় দেওয়া হয়েছে কোনওরকম  আইনি দায় থেকে, তা কেন করা হলো- এই প্রশ্নও তিনি তোলেন। তাঁর দাবি, এই ধরনের আইনি ফাঁকফোকর একমাত্র তখনই রেখে দেওয়া হয় যখন কোনও অসৎ উদ্দেশ্য থাকে। তৃতীয়ত, ভোটকেন্দ্রের সিসিটিভি ফুটেজ ৪৫ দিনের মাথায় নষ্ট করে দেওয়ার নিয়ম কেন রাখা হয়েছে- এই প্রশ্নে তিনি সরকারের দেওয়া যুক্তি “স্টোরেজ সমস্যার” প্রসঙ্গকে খারিজ করেন। তাঁর বক্তব্য- এটা তথ্য সংরক্ষণের ব্যাপারই নয়, বরং ভোট “চুরি” করার কৌশল।

রাহুল গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য চারটি বিকল্প প্রস্তাব রাখেন। ভোটের এক মাস আগে সব রাজনৈতিক দলের কাছে মেশিনে পাঠযোগ্য ভোটার তালিকা দেওয়া, সিসিটিভি ফুটেজ নষ্ট করার  আইন প্রত্যাহার, ইভিএমের পুরো প্রযুক্তিগত ডিজাইন প্রকাশ করে নিরপেক্ষ সংস্থাকে দিয়ে পরীক্ষা করা, এবং নির্বাচন কমিশনারদের ওপর থেকে আইনি সুরক্ষা তুলে নেওয়া। তিনি সরাসরি নির্বাচন কমিশনকে সতর্ক করে বলেন, “আমরা আপনাদের খুঁজে বের করব" এবং  আইন বদলানো হবে এবং প্রয়োজনে অতীতেও প্রয়োগ করা হবে।

এই পুরো বিতর্কে তিনি আরও কিছু বিষয় যোগ করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলিকেই আজ আরএসএস কবজা করে নিচ্ছে। গান্ধী হত্যার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “প্রকল্পটি তখনই শেষ হয়নি, আজ কেন্দ্রীয় এজেন্সি থেকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা, সবকিছুর ওপরই দখলদারি কায়েমের চেষ্টা চলছে এবং নির্বাচন কমিশন তার মূলে।”

যদিও রাহুলের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে অভিযোগগুলোকে ভিত্তিহীন বলে খারিজ করে দেন। তিনি দাবি করেন, ইভিএম তো কংগ্রেসই প্রথম এনেছিল, ১৯৮৭ সালে রাজীব গান্ধী শুরু করেন পরীক্ষামূলক ব্যবহার, আর ১৯৯১ সালে নরসিমা রাও সরকার তার ব্যবহার বাড়ায়। তিনি আরও বলেন, ১৯৬১ ও ১৯৭১ সালের সংসদীয় কমিটি ইলেকট্রনিক ভোটিংয়ের পরামর্শ দিয়েছিল। তাঁর বক্তব্য, বিজেপি শুধু বহু পুরনো একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে। কিন্তু বিরোধীরা আগেভাগেই নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করতে চাইছে।

দিনের শেষে এই বিতর্ক স্পষ্ট করেছে যে আগামী দিনে যাবতীয় ভোটের আগে রাজনৈতিক সংঘর্ষের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও বৈধতা। বিরোধীদের দাবি, গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই এখন ভোটাধিকার সুরক্ষিত করার লড়াই, আর শাসক দল বিজেপির মতে-  এগুলো সবই সম্ভাব্য পরাজয়ের অজুহাত।  তবে লোকসভার এই বিতর্কের পর আর সাম্প্রতিক সময়ের যাবতীয় নির্বাচনের পর সন্দেহ নেই যে ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থার স্বচ্ছতা এখন সংসদের ভেতরে-বাইরে সবচেয়ে তীব্র রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।