আজকাল ওয়েবডেস্ক: দেশের ইতিহাসে প্রথম বার ডিএনএ প্রযুক্তির সাহায্যে হাতি গণনার রিপোর্ট প্রকাশ পেতেই কপালে চিন্তার ভাঁজ পরিবেশবিদদের। ‘সিঙ্ক্রোনাস অল-ইন্ডিয়া এলিফ্যান্ট এস্টিমেশন ২০২১-২৫’ শীর্ষক এই সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশ জুড়ে বুনো হাতির সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২২,৪৪৬-এ। পাঁচ বছর আগে, ২০১৭ সালের গণনায় এই সংখ্যা ছিল ২৭,৩১২। অর্থাৎ, বুনো হাতির সংখ্যা কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ।

 

তবে, পরিবেশ মন্ত্রকের আধিকারিকরা এখনই এই দুই পরিসংখ্যানের সরাসরি তুলনা টানতে নারাজ। এখনই এবিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা অনুচিত বলেই তাঁদের মত। শোনা গিয়েছে এক অদ্ভুত যুক্তি, এ বারের গণনায় যে অত্যাধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, তা আগের চেয়ে অনেক বেশি নির্ভুল। তাই পুরনো রিপোর্টের সঙ্গে এর তুলনা টানা যুক্তিসঙ্গত হবে না। তবে রিপোর্টটিকে সম্পূর্ণ নাকচ করতেও অক্ষম তাঁরা। বরং আধিকারিকদের একাংশের দাবি, এই নতুন সমীক্ষা আগামী দিনের জন্য একটি মজবুত ভিত্তি (বেসলাইন) তৈরি করে দিল।

এত দিন পর্যন্ত দেশে হাতি গোনা হতো মূলত চাক্ষুষ দেখে অথবা জঙ্গলে পড়ে থাকা মলের স্তূপ গুনে। এই পদ্ধতিতে একই হাতি একাধিক বার গোনা হয়ে যাওয়ার বা গণনার বাইরে থেকে যাওয়ার মতো ভুলের অবকাশ ছিল। সেই খামতি দূর করতেই এ বার বাঘ গণনার ধাঁচে ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিং-এর সাহায্য নেওয়া হয়েছে। দেশ জুড়ে হাতির বিচরণভূমিগুলি থেকে প্রায় ২১ হাজার মলের নমুনা সংগ্রহ করেন গবেষকেরা। সেই নমুনা বিশ্লেষণ করে ৪,০৬৫টি স্বতন্ত্র হাতিকে শনাক্ত করা হয় এবং তার ভিত্তিতেই ‘মার্ক-রিক্যাপচার’ মডেলে হাতির মোট সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে।

 

রিপোর্ট অনুযায়ী, আঞ্চলিক ভাবে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা এখনও হাতিদের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল। সেখানে ১১,৯৩৪টি হাতির বাস। এর পরেই রয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতের পার্বত্য অঞ্চল এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, যেখানে ৬,৫৫৯টি হাতি রয়েছে। রাজ্যগুলির মধ্যে শীর্ষে রয়েছে কর্ণাটক (৬,০১৩)।

 

কিন্তু সংখ্যার এই টানাপোড়েনের আড়ালে যে গভীর সঙ্কট লুকিয়ে রয়েছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই রিপোর্ট। আধিকারিকদের মতে, হাতির সংখ্যা কমার মূল কারণ তাদের স্বাভাবিক বাসস্থানের দ্রুত সংকোচন এবং খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাওয়া। যথেচ্ছ ‘উন্নয়নমূলক’ প্রকল্প, খনিজ উত্তোলন, জঙ্গলের বুক চিরে চলে যাওয়া রেললাইন এবং জাতীয় সড়ক এবং বাণিজ্যিক চাষাবাদের আগ্রাসনে হাতিদের স্বাভাবিক যাতায়াতের পথ বা করিডরগুলি ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাসস্থান হারানোর ফলে খাবারের সন্ধানে তারা লোকালয়ে হানা দিচ্ছে, যার অনিবার্য পরিণতি- মানুষ-হাতির ভয়াবহ সংঘাত। রিপোর্ট বলছে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, ট্রেনের ধাক্কায় এবং প্রতিহিংসার জেরে মানুষের হাতে হাতির অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনাই এখন সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ।

পরিবেশবিদদের মতে, এই রিপোর্ট কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি একটি সতর্কবার্তা। ভারতের জাতীয় ঐতিহ্যবাহী এই প্রাণীকে বাঁচাতে হলে শুধুমাত্র বিচ্ছিন্ন ভাবে জঙ্গলের সুরক্ষাই যথেষ্ট নয়, তাদের অবাধ বিচরণের জন্য করিডরগুলিকে সুরক্ষিত রাখা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর তার জন্য প্রয়োজন একটি সুসংহত এবং বিজ্ঞান-চালিত সংরক্ষণ নীতি। বিরোধীদের অভিযোগ অরণ্য সংরক্ষণ তো দূর, উল্টে যেটুকু বনাঞ্চল অবশিষ্ট রয়েছে সেগুলিও ধনকুবেরদের বিকিয়ে দিচ্ছে মোদি সরকার। আর তার প্রভাব পড়ছে বন্যপ্রাণীর সংখ্যার উপর।