আজকাল ওয়েবডেস্ক: ২০২৫ সালের বিহার নির্বাচনের আগে, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দেশব্যাপী ভোটার তালিকার নিবিড় পুনর্বিবেচনার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিতর্ক উস্কে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে অ-নাগরিকরা ভারতের ভোটার তালিকায় কীভাবে অন্তর্ভুক্ত হল তা নিয়ে। এই প্রশ্নের উত্তর ফর্ম ৬। বিষয়টি স্বল্প আলোচিত হলেও বহুল ব্যবহৃত।

ফর্ম ৬ কী?
১৯৬০ সালের ভোটার নথিভুক্তকরণ বিধিমালার অধীনে ফর্ম ৬, ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী ভারতীয় নাগরিকদের বাসস্থানের নিরিখে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করার অনুমতি দেয়। তবে, ফর্ম ৬-এর জন্য আবেদনকারীদের ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ জমা দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। বয়স এবং বাসস্থান নির্ধারণকারী নথি-সহ একটি স্ব-ঘোষণা যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয়।

সমালোচকদের যুক্তি, এই ফাঁকফোকরের কারণেই অযোগ্য ব্যক্তিরা, বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে অভিবাসন বেশি এবং সীমান্ত নজরদারি শিথিলতা বেশি, সেখানে ফর্ম ৬ এর মাধ্যমে ভোটার তালিকায় নাম তোলা বেশি হয়েছে। 

আধার: নাগরিকত্ব নয়, পরিচয়
ভারতের সর্বাধিক উপলব্ধ পরিচয়পত্র আধার, বয়স এবং বসবাসের প্রমাণ হিসেবে ফর্ম ৬-এ প্রায়শই ব্যবহৃত হয়। ফর্মটিতে একাধিকবার আধার উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু 'নাগরিক' শব্দটি মাত্র দু'বার উল্লেখ করা হয়েছে।

যাইহোক, নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য আধার বৈধ নথি নয়। নির্বাচন কমিশনের ২৪শে জুন বিহারে বিশেষ নিবিড় সংশোধন (SIR) চলাকালীন নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য ১১টি গ্রহণযোগ্য নথির তালিকা থেকে আধারকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।

[আরও পড়ুন- কঠিন হচ্ছে আধারের জন্য প্রাপ্তবয়স্কদের নাম নথিভুক্তকরণ প্রক্রিয়া! কী পরিকল্পনা কেন্দ্রীয় সরকারের?]

এই তালিকায় পাসপোর্ট, জন্ম শংসাপত্র বা আবাসিক শংসাপত্রের মতো নথি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে যে, আধার কেবল একটি পরিচয়পত্র, জাতীয়তা প্রমাণ করে না।

বিশেষ নিবিড় সংশোধন কী?
ভোটার তালিকা স্বচ্ছ করার এবং অ-নাগরিক-সহ অযোগ্যদের নাম অপসারণের একটি বিস্তৃত প্রক্রিয়া। সর্বশেষ এই ধরনের প্রক্রিয়া ২০০৩-২০০৪ সালে করা হয়েছিল। তারপর থেকে, প্রতি বছর কেবল সংক্ষিপ্ত সংশোধন করা হয়েছে। এই সীমিত আপডেটের ফলে সম্ভবত লক্ষ লক্ষ অযাচাইকৃত নাম তালিকায় থেকে গিয়েছে।

বিহারে, বিশেষ নিবিড় সংশোধন-এ ঘরে ঘরে যাচাইকরণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কিন্তু, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আধার, রেশন কার্ড এবং ১০০ দিনের কাজ, জব কার্ডের মতো সাধারণভাবে ব্যবহৃত নথিপত্রের সময় এবং বাদ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিষয়টি এখন সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব এই প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেছেন এবং একটি ব্যক্তিগত উদাহরণ উদ্ধৃত করেছেন। বলেছেন, "আমার স্ত্রী, যিনি আগে দিল্লিতে ভোটার ছিলেন, আমাদের বিয়ের পর বিহারে তাঁর ভোটার আইডি তৈরি করেছিলেন, তাঁর আধার কার্ডের উপর ভিত্তি করে। তাহলে, কেন বিহারে বিশেষ নিবিড় সংশোধন-এর জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্রের তালিকা থেকে আধার কার্ড বাদ দেওয়া হচ্ছে?" 

উদ্বেগ প্রকাশ শুধু তেজস্বীই করেননি। রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, আধার বিহারের অনেক জেলায় সবচেয়ে সহজলভ্য নথি হিসাবে বিবেচিত এবং এর বাদ দেওয়ার ফলে বিপুল সংখ্যক প্রকৃত ভোটার ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।

ভোটার তালিকায় অ-নাগরিকরা কীভাবে স্থান পেল?
প্রাক্তন নির্বাচনী আধিকারিক স্বীকার করেছেন যে, নতুন ভোটার নথিভুক্তকরণের প্রক্রিয়াটি বছরের পর বছর ধরে কম কঠোর হয়ে উঠেছে। ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদনে একজন প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, “১৯৫২ সালে যখন ফর্ম ৬ চালু করা হয়েছিল, তখন কেউই এত বড় আকারের অবৈধ অভিবাসীদের আগমনের কথা আগে থেকে ভাবতে পারেনি।”

প্রাক্তন নর্বাচন কমিশনার উল্লেখ করেছেন যে, ভোটার তালিকাভুক্তি বাড়ানোর জন্য নির্বাচন কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলির উপর চাপ প্রায়শই শিথিল যাচাইকরণের দিকে পরিচালিত করে। বুথ-স্তরের কর্মকর্তা (বিএলও) এবং রাজনৈতিক দলের এজেন্টরা ভোটার আবেদন সংগ্রহ এবং প্রক্রিয়াকরণে গভীরভাবে জড়িত। এই তৃণমূল স্তরের চাপ, ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে, অ-নাগরিকদের এড়িয়ে যেতে পারে।

ইন্ডিয়া টুডে প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের উদ্ধৃতি তুলে বলেছে, “আধারকে ইপিআইসি (ভোটার আইডি) এর সঙ্গে সংযুক্ত করা কেবল ডুপ্লিকেট এন্ট্রি এবং অপসারণের একটি পদক্ষেপ। এটি নাগরিকত্ব যাচাই করতে পারে না।” ।

নাগরিকত্ব: ছাঁকনির অভাব
২০১৬ সালে, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু সংসদে বলেছিলেন যে- ভারতে ২ কোটি অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী রয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ পূর্ব সীমান্তবর্তী জেলাগুলির জনসংখ্যার বিন্যাস পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করেছেন, যা অপ্রমাণিত অভিবাসনের মাত্রা নির্দেশ করে।

রাজনৈতিক কুশলী অমিতাভ তিওয়ারি বলেছেন যে, নাগরিকত্বের প্রমাণ বাধ্যতামূলক না করা পর্যন্ত, সমস্যাটি টিকে থাকবে। তাঁর কথায়, "প্রথমবার ভোটারদের তালিকাভুক্তির সময় নাগরিকত্বের প্রমাণ, কেবল ঘোষণা নয়, বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।"  

এগিয়ে যাওয়ার উপায়
নির্বাচন কমিশনের আধিকারকরা এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে মন্তব্য করতে অস্বীকার  জানিয়েছে। তবে, একাধিক প্রাক্তন কমিশনার বলেছেন যে, কেবল ফর্ম ৬ নয়, পুরো নির্বাচনী নথিভুক্তকরণ কাঠামো সংশোধন করার সময় এসেছে।