আজকাল ওয়েবডেস্ক: আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক সংস্থা International Institute for Democracy and Electoral Assistance (International IDEA)–এর চেয়ারশিপ গ্রহণ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন এই দায়িত্বকে “ভারতের গণতান্ত্রিক সাফল্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি” বলে উল্লেখ করলেও, সরকারি নথি ও IDEA-র সংবিধান অনুযায়ী এটি বহু বছর আগে নির্ধারিত একটি নিয়মিত রোটেশন, কোনও বিশেষ সম্মান বা পারফরম্যান্সভিত্তিক নির্বাচন নয়।

৩ ডিসেম্বর ২০২৫ নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার ২০২৬ সালের জন্য IDEA-র Council of Member States-এর চেয়ারম্যান হয়েছেন। পরে সামাজিক মাধ্যমে তিনি দাবি করেন—“৩০ বছরে প্রথমবার বিশ্বের ৩৭টি গণতান্ত্রিক দেশ ভারতকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং এটি মুক্ত, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন পরিচালনার স্বীকৃতি।” তাঁর এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করেই আপত্তি ওঠে। X–এ তাঁর বক্তব্য লক্ষ্য করে যুক্ত হয় একটি ‘কমিউনিটি নোট’, যেখানে বলা হয় এই চেয়ারশিপ বার্ষিক ও আঞ্চলিকভাবে ঘূর্ণায়মান এবং ২০২৬ সালে ভারতের দায়িত্ব নেওয়া আগেই নির্ধারিত ছিল। সুইজারল্যান্ড ২০২৫ সালে দায়িত্ব পালন করেছে, এরপর ক্যালেন্ডার অনুসারে ভারতের পালা এসেছে। আন্তর্জাতিক IDEA-এর নথিতে “merit-based selection”-এর কোনও উল্লেখ নেই। ফলে এটি আমন্ত্রণ নয়, বরং পূর্বনির্ধারিত দায়িত্ব—এমনটাই বিশেষজ্ঞদের মত।

অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, নির্বাচন কমিশনের এই ভাষ্য ২০২৩ সালের G20 সভাপতিত্বের সময় সরকারের রাজনৈতিক প্রচারের সঙ্গে মিল রাখে। সে সময়েও নিয়মিত রোটেশনের  দায়িত্বকে রাষ্ট্রীয় সাফল্য হিসেবে তুলে ধরার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। এবার একই ধরনের প্রচার নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন—একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যখন শাসক দলের প্রচারভঙ্গি গ্রহণ করে, তখন সেই প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা প্রশ্নের মুখে পড়ে।

নির্বাচন কমিশনকে ঘিরে সাম্প্রতিক বিতর্কগুলিও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। মডেল কোড অফ কন্ডাক্ট লঙ্ঘনের অভিযোগে পক্ষপাত, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণায় বিলম্ব, ইলেকটোরাল বন্ড নিয়ে নীরবতা এবং বিশেষ ভোটার তালিকা পুনর্বিবেচনা (Special Intensive Revision – SIR) নিয়ে অভিযোগ ইতিমধ্যেই কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক দায়িত্বকে “স্বীকৃতি” হিসেবে চিত্রিত করা অনেকের কাছে একটি প্রতিরক্ষামূলক প্রচেষ্টা বলে মনে হচ্ছে—যেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেখিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ প্রশ্নগুলোকে আড়াল করা যায়।

প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার অশোক লবাসা সম্প্রতি Frontline–এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বর্তমান কমিশনের কাজকর্ম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিশেষ করে ভোটার তালিকা পুনর্বিবেচনার প্রক্রিয়ায় (SIR) ভোটারদের নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাকে তিনি “বর্জনমুখী” বলে আখ্যা দেন। তাঁর বক্তব্য—এই প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয় এবং বিশেষত বিহারে এটি এমনভাবে পরিচালিত হয়েছে, যেন প্রশাসনের লক্ষ্য গুপ্তভাবে NRC প্রয়োগ করা। তাঁর মতে, এই বিষয়টি এখনও সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়েছে, যা উদ্বেগের।

সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ইঙ্গিত করছে—যেখানে সত্যটি কেবল একটি নির্ধারিত প্রশাসনিক পালা, সেখানে সেটিকে “বিশ্বের স্বীকৃতি” হিসেবে তুলে ধরা গণতান্ত্রিক সততার সঙ্গে যায় না। নির্বাচন কমিশন যখন আগামী বছরে আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন দেশবাসীর কাছে প্রশ্ন রয়ে যায়—নিজেদের ঘরের ভিতরই যখন স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বিতর্কিত, তখন বিশ্বকে গণতন্ত্র শেখানোর দাবি কতটা বিশ্বাসযোগ্য?