আজকাল ওয়েবডেস্ক: দিল্লিতে টানা কয়েকদিন ধরে ভয়াবহ মাত্রার বায়ুদূষণ চললেও সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে এই সংকট নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি। ১ ডিসেম্বর থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা অধিবেশনের শেষ দিনেও বায়ুদূষণ প্রশ্নে সংসদ নীরবই থেকেছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই সংসদে দেওয়া এক লিখিত উত্তরে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক দাবি করেছে, বায়ুদূষণ (AQI) ও ফুসফুসজনিত রোগের মধ্যে “সরাসরি কোনও সম্পর্ক প্রমাণিত হয়নি”- যা নিয়ে তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের (CPCB) তথ্য অনুযায়ী, ১৯ ডিসেম্বর বিকেল ৪টেয় দিল্লির AQI বা বায়ুদূষণের মাত্রার পরিমাণ ছিল ৩৭৪, যা ‘খুব খারাপ’ শ্রেণিভুক্ত। এর আগের দিন এই সূচক ছিল ৩৭৩। চলতি মাসে টানা ন’দিন দিল্লির বায়ুমান ‘খুব খারাপ’ বা ‘সঙ্কটজনক’ স্তরে রয়েছে। সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৮ সালের পর এই প্রথম ডিসেম্বর মাসে দিল্লি এত দীর্ঘ সময় ধরে মারাত্মক বায়ুদূষণের কবলে।

লোকসভায় বায়ুদূষণ নিয়ে আলোচনার কথা থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত হয়নি। সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু এই ব্যর্থতার জন্য বিরোধীদের দায়ী করে বলেন, বিরোধী সাংসদদের আচরণের কারণে আলোচনা সম্ভব হয়নি। তিনি দাবি করেন, কয়েকজন কংগ্রেস সাংসদ নাকি বায়ুদূষণ নিয়ে বিতর্কের প্রয়োজনই নেই বলে জানিয়েছিলেন।

এরই মধ্যে ১৮ ডিসেম্বর সংসদে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী কীর্তি বর্ধন সিংহ বলেন, বায়ুদূষণ  ও ফুসফুসের রোগের মধ্যে “সরাসরি কোনও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার মতো চূড়ান্ত তথ্য নেই।” এই মন্তব্য তিনি করেন বিজেপিরই সাংসদ লক্ষ্মীকান্ত বাজপেয়ীর প্রশ্নের উত্তরে। বাজপেয়ী জানতে চান, দীর্ঘদিন ধরে বিপজ্জনক মাত্রার বায়ুদূষণের ফলে দিল্লি-এনসিআরের মানুষের মধ্যে ফুসফুসের রোগ ও ফুসফুসের কার্যক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ার বিষয়ে সরকার জানে কি না।

সিংহ তাঁর উত্তরে স্বীকার করেন যে বায়ুদূষণ শ্বাসযন্ত্রজনিত রোগের একটি ‘ট্রিগারিং ফ্যাক্টর’, কিন্তু একইসঙ্গে বলেন যে বায়ুদূষণ  ও ফুসফুসের রোগের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক প্রমাণিত নয়। তবে বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের মতে, এই দাবি বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

২০২৫ সালে Environmental Pollution জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় তামিলনাড়ুর চার বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বায়ুদূষণ ও শ্বাসযন্ত্রের রোগের মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে। ২০২৩ সালে Scientific Reports-এ প্রকাশিত আরেকটি গবেষণায় ভারতে অতিরিক্ত বায়ুদূষণ  ও ফুসফুসের ক্যানসারের হার বৃদ্ধির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক সম্পর্ক চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ২৭টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়ার সঙ্গে ফুসফুসের  রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে।

সমালোচকদের মতে, সরকারের অবস্থান আরও প্রশ্নবিদ্ধ কারণ বায়ুদূষণের মাত্রা দেখিয়েই প্রশাসন নাগরিকদের ঘরে থাকার পরামর্শ দেয়। ১৩ ডিসেম্বর কমিশন ফর এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট (CAQM) শিশু, বৃদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্তদের বাইরে না বেরোতে নির্দেশ দিয়েছিল, যখন দিল্লির AQI বা বায়ুদূষণের মাত্রা ৪৪৮-এ পৌঁছেছিল।

বর্তমানে দিল্লি-এনসিআরে গ্রেডেড রেসপন্স অ্যাকশন প্ল্যান (GRAP)-এর চতুর্থ ধাপ কার্যকর রয়েছে। কাগজে-কলমে নির্মাণকাজ বন্ধ রাখা ও দূষণকারী যানবাহনের উপর কড়াকড়ি আরোপ করা হলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ১৬ ডিসেম্বর আম আদমি পার্টির নেতা সৌরভ ভরদ্বাজ একটি ভিডিও প্রকাশ করে দাবি করেন, GRAP 4 কার্যকর থাকা সত্ত্বেও দিল্লির পুষ্পাঞ্জলি ফার্মস এলাকায় ২.৫ একর জমিতে বেআইনি নির্মাণকাজ চলেছে। তাঁর অভিযোগ, বিজেপির এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতায় রাতভর এই কাজ হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সংসদে আলোচনার অনুপস্থিতি, বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সম্পর্ক অস্বীকার এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর প্রয়োগের ঘাটতি— এই তিনের সম্মিলিত ফলই দিল্লির বায়ুদূষণ সংকটকে আরও গভীর করে তুলছে।