আজকাল ওয়েবডেস্ক: সাদা কাপড়ে মোড়ানো এক মৃতদেহ, শোকের সুরে উচ্চারিত “রাম নাম সত্য হ্যায়” — এমনই এক শ্মশানযাত্রা দেখে হতবাক হয়ে গেল গোটা গ্রাম। কিন্তু ক’ মিনিটের মধ্যেই ঘটল এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। মৃত বলে যাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সেই মানুষটিই হঠাৎ উঠে বসলেন নিজেরই আর্থি থেকে! ঘটনাটি ঘটেছে গয়ার কোনচি গ্রামে। যিনি এই ব্যতিক্রমী কাণ্ড ঘটিয়েছেন, তাঁর নাম মোহনলাল — ভারতীয় বায়ুসেনার অবসরপ্রাপ্ত ওয়ারেন্ট অফিসার।
৭৪ বছর বয়সি মোহনলাল নিজের সঞ্চিত অর্থ থেকে প্রায় ছয় লক্ষ টাকা ব্যয় করে গড়েছেন একটি ‘মুক্তিধাম’ — গ্রামবাসীদের জন্য নির্মিত এক আধুনিক শ্মশানভূমি। দীর্ঘদিন ধরেই বর্ষাকালে স্থানীয় নদীর জলের স্তর বেড়ে যাওয়ায় মৃতদেহ দাহ করতে বিপাকে পড়তেন গ্রামবাসীরা। অনেক সময় নদীর ধারে পৌঁছানোও কঠিন হয়ে পড়ত, ফলে শোকের সময়েও পরিবারগুলোকে পড়তে হতো নানা সমস্যায়। সেই কষ্ট চোখে দেখে নিজের উদ্যোগেই এই মুক্তিধাম নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন মোহনলাল।
তবে এই মুক্তিধামের উদ্বোধন তিনি করলেন একেবারে অভিনব উপায়ে — নিজেরই প্রতীকী অন্ত্যেষ্টি করে। পরিকল্পনা ছিল সম্পূর্ণ নাটকীয়। গ্রামবাসীরা যেমন কোনও বাস্তব মৃত্যুর সময় করে থাকেন, ঠিক তেমনভাবেই আয়োজন করা হয়েছিল সবকিছু। সাদা কাপড়ে মোড়ানো মোহনলালকে খাটিয়ায় শুইয়ে গ্রাম ঘুরে শ্মশান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। আশপাশের মানুষজন ভাবেন, তিনি সত্যিই প্রয়াত হয়েছেন। শোকের আবহে “রাম নাম সত্য হ্যায়” ধ্বনি উঠতে থাকে।
কিন্তু মুক্তিধামের দ্বারে পৌঁছানোর পরেই মোহনলাল হঠাৎ উঠে বসে জানান, এই অন্ত্যেষ্টি আসলে প্রতীকী — উদ্বোধনের এক অভিনব রূপ। তাঁর উদ্দেশ্য, সমাজে সচেতনতা তৈরি করা এবং দেখানো যে এই নতুন মুক্তিধামই ভবিষ্যতে গ্রামের সবার জন্য মর্যাদাপূর্ণ বিদায়ের স্থান হতে পারে।
আরও পড়ুন: তাজমহল নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের সমস্যা কোথায় জানেন কি? কারণ জানলে চমকে উঠবেন
উদ্বোধনের সময় তিনি প্রতীকীভাবে নিজের কুশপুতুল দাহ করেন। সেখানে বাজছিল পুরনো হিন্দি গানের সুর— “চল উড় যা রে পাঞ্চি, অব দেশ হুয়া বেগানা।” এরপর ঐ কুশপুতুলের ছাই ঐতিহ্য মেনে নিকটবর্তী নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের শেষে মোহনলাল নিজেই আয়োজন করেন এক সমবায় ভোজের, যেখানে গ্রামের শতাধিক মানুষ অংশ নেন।
এ বিষয়ে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোহনলাল বলেন, “আমি চেয়েছিলাম দেখতে, কে আসলে আমাকে ভালোবাসে, কে পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা — আমি চেয়েছিলাম এমন একটি জায়গা তৈরি করতে, যেখানে কারও মৃত্যু হলে পরিবারকে আর কষ্ট পেতে না হয়। অবসর নিয়েও যদি সমাজের জন্য কিছু করতে পারি, সেটাই আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি।”
স্থানীয় প্রশাসনের এক কর্তা জানিয়েছেন, গয়া জেলায় এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম। সাধারণত সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে মুক্তিধাম গড়ে ওঠে, কিন্তু কোনও ব্যক্তি নিজেই তা নির্মাণ করে নিজের প্রতীকী অন্ত্যেষ্টির মাধ্যমে উদ্বোধন করেছেন — এমন নজির বিরল। মোহনলালের এই মানবিক উদ্যোগ আজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই প্রথমে ভাবেন, তিনি কৌতূহলবশত নিজের শেষযাত্রা দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু পরে জানা যায়, এটি নিছক আত্মপ্রদর্শন নয়, বরং নিঃস্বার্থ সমাজসেবার এক অনন্য উদাহরণ।
গ্রামবাসী রমেশ যাদব বলেন, “বর্ষায় আমরা মৃতদেহ দাহ করতে পারতাম না, খুব কষ্ট হতো। এখন মোহনলালজির কারণে আমাদের একটা স্থায়ী জায়গা হয়েছে। এমন মানুষ সত্যিই বিরল।” এইভাবে, অবসরপ্রাপ্ত এক বায়ুসেনা অফিসার নিজের জীবনদর্শন ও মানবিকতার মিলনে গড়ে তুললেন এক এমন অধ্যায়, যা শুধুমাত্র গয়া নয়, সারা দেশের জন্য এক অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে থাকবে।
