আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিহারের বৈশালীর শাহমাইয়ান রোহুয়া গ্রামের ১৮ বছর বয়সি মনি কুমারী আজ তার বন্ধুদের মধ্যে এক রোল মডেল। চোখে দুষ্টুমি মেশানো আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে মনে করিয়ে দেয় সেই মুহূর্তগুলিকে, যখন সমাজের বাঁধা ভেঙে নিজের পথ নিজেই তৈরি করেছে — ১৬ বছর বয়সে বিয়ে প্রত্যাখ্যান করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কিংবা প্রতিদিন ১৮ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে কলেজে পৌঁছনো।

৬ নভেম্বর, জীবনের প্রথম ভোট দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে মনি। কিন্তু এবারও সে এক নীরব সামাজিক নিয়ম ভাঙতে চলেছে — জাতির ভিত্তিতে নয়, নিজের বিবেক অনুযায়ী ভোট দেবে সে।

মনির জাতিগত পরিচয় কুশওহা সম্প্রদায়ের, যারা ঐতিহ্যগতভাবে বিজেপির সমর্থক বলে পরিচিত। কিন্তু মনির ভাবনা অন্যরকম। সে বলছে, “শিক্ষার খরচ দিন দিন বাড়ছে। সরকার যদি সত্যিই মেয়েদের উন্নতি চায়, তাহলে স্নাতক শেষে টাকা দেওয়ার বদলে সেমেস্টারভিত্তিক সহায়তা দেওয়া উচিত।”

বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের মেয়েশিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন কল্যাণ প্রকল্পের উপকারভোগী হলেও মনির ভোট এবার মহাগঠবন্ধনের দিকে ঝুঁকেছিল। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে রাজনৈতিক মতবিনিময়েই বদলে গেল তার সিদ্ধান্ত। মা তাকে মনে করিয়ে দিলেন লালু-যুগের ‘জঙ্গলরাজ’ — ডাকাতি, ধর্ষণ, রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ছিনতাই। মায়ের সেই স্মৃতি মনির মনে ভয় জাগিয়েছে, এবং শেষ পর্যন্ত তার ভোট যাবে এনডিএর দিকে।

বিহারের মোট জনসংখ্যার ৫৮ শতাংশই ২৫ বছরের নিচে — অর্থাৎ প্রায় এক-চতুর্থাংশ ভোটার জেনারেশন জেডের অন্তর্ভুক্ত। এদের মধ্যেই ১৪.৭ লক্ষ প্রথমবারের ভোটার। রাজনৈতিক দলগুলো তাই যুবসমাজকে আকৃষ্ট করার জন্য একের পর এক প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে — চাকরি, শিক্ষা ও স্থানীয় উন্নয়ন এর মূল ইস্যু।

তবে এনডিএ-র তরফে প্রচারিত ‘জঙ্গলরাজে ফেরা’র আশঙ্কা অনেক তরুণ ভোটারের মনকে প্রভাবিত করছে। কেউ পরিবার থেকে শুনছে সেই সময়ের কাহিনি, আবার কেউ ইউটিউবে ইতিহাস খুঁজে দেখছে। জেহানাবাদের তরুণ প্রথম কুমার জন্মেছিল ২০০৫ সালে, যখন নীতীশ কুমার ক্ষমতায় এলেন। তার কলেজের হোস্টেলে বসে ইউটিউবে হঠাৎই সে দেখে ফেলেছিল ১৯৯৭ সালের রণবীর সেনার হাতে ৫৮ জন দলিত হত্যার ভয়াবহ দৃশ্য।

তবু সে মহাগঠবন্ধনকেই সমর্থন করছে। কারণ, তার মতে, “নীতীশবাবু ছাত্রদের জন্য কিছুই করেননি। চাকরি নেই, শিক্ষা ভেঙে পড়েছে। শুধু মহিলাদের ভোটব্যাঙ্ক গড়া নিয়ে ব্যস্ত।” তবে সে এটাও স্বীকার করে, কিছু তরুণ আবার নিজেদের জাতিগত ইতিহাসের ‘অবিচার’ আবিষ্কার করে প্রতিশোধের মানসিকতায় আক্রান্ত হচ্ছে।

পাটনা সায়েন্স কলেজের ছাত্র শুভম কুমার ভূমিহার জাতির। সে চায় জাতপাতের রাজনীতি থেকে মুক্ত হতে। কিন্তু একদিন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ঘুরে দেখল, কিছু যাদব ছাত্র আরজেডি জয়ী হলে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের গান বাজাচ্ছে। “আমাদের পরিবার তখন ঝকমকে পোশাক পরত না, কারণ যাদবরা টার্গেট করত,” মনে করিয়ে দেন শুভমের দাদা। সেই ভয়ের স্মৃতি আজও পরিবারের ভোট-ভাবনাকে প্রভাবিত করে। ফলত শুভম ও তার পরিবার আবারও বিজেপিকেই ভোট দেবে।

পাটনার সমাজকর্মী আখতারি বেগম মনে করিয়ে দেন, “জঙ্গলরাজের সময় রাস্তায় থাকা নিরাপদ ছিল না। আমরা অনেকবার রাত কাটিয়েছি পাটনা রেলস্টেশনে, শুধু নিরাপত্তার জন্য।” ১৯ বছর বয়সি আফিফা পারভিনও তার পরিবারের কাছ থেকে সেই সময়ের কথা শুনেছে। এখন যদিও সে অবাধে শহরে ঘোরাফেরা করে, সেই স্মৃতি তাকে আরজেডিকে সরাসরি ভোট দিতে বাধা দেয়। তাই সে, পরিবারের মতোই, কংগ্রেসকে ভোট দেবে—এই আশায় যে তারা আরজেডিকে সংযত রাখবে।

তবুও প্রশ্ন থেকে যায়—কতদূর অতীতের স্মৃতি বর্তমান দারিদ্র্যের ভারে টেকে? ২০২২ সালের জাতিগত আদমসুমারি অনুযায়ী, বিহারের ৩৫ শতাংশ পরিবার মাসে ৬,০০০ টাকারও কম আয় করে। বিহার শরিফের মন্সুরনগরে কুশওহা যুবক প্রকাশ কুমার বলছেন, “মহিলাদের টাকা দিচ্ছে, কিন্তু দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে নিচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ বাঁচবে কীভাবে?” প্রকাশ এবার পরিবর্তনের পক্ষে—তার মতে, “বদল দরকার, আর সেই বদলের আশা তেজস্বীই দিতে পারেন।”

পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টসের ছাত্র ঈশান্ত কুমার বলছে, “জাত নিয়ে এত কথা বলেও কোনও উন্নতি হয়নি। এখন মূল প্রশ্ন চাকরি আর শিক্ষা। কিন্তু কেউ সেগুলো নিয়ে কথা বলছে না।” তবু হতাশার মধ্যেও কিছুটা আশা খুঁজছে সে—“দু’পক্ষই ব্যর্থ, তবে জন সুরাজ হয়তো নতুন বিকল্প দিতে পারে।”

বিহারের তরুণ ভোটারদের মনস্তত্ত্ব তাই দ্বিধাগ্রস্ত—অতীতের ভয় ও বর্তমানের অভাবের মধ্যে দুলছে তাদের সিদ্ধান্ত। কেউ নিরাপত্তার আশায় এনডিএর দিকে, কেউ পরিবর্তনের খোঁজে মহাগঠবন্ধনের দিকে, আর কেউ খুঁজছে নতুন বিকল্পের পথ। এই দ্বিধাই ঠিক করবে বিহারের আগামী রাজনৈতিক সমীকরণ—জঙ্গলরাজের স্মৃতি, নীতীশের স্থিতি, নাকি যুবসমাজের নতুন উচ্চাকাঙ্ক্ষা কোনটা বিজয়ী হবে, সেটাই এখন দেখার।