পৃথিবীর জন্মের খুব বেশি দিন পর নয়, আমাদের গ্রহটি এক মহাজাগতিক আঘাতের মুখে পড়ে। মঙ্গলগ্রহের সমান আকারের এক বিশাল পিণ্ড পৃথিবীর সঙ্গে সরাসরি ধাক্কা খায়। এই ভিনগ্রহী বস্তুটির নাম ছিল থেইয়া । সংঘর্ষে থেইয়া সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় এবং এর টুকরো-টাকরা, সঙ্গে পৃথিবীর কিছু অংশ মহাকাশে ছিটকে পড়ে। সেই প্রচণ্ড ধাক্কার ফলেই জন্ম নেয় আমাদের চাঁদ।
2
10
এই তত্ত্বটি চাঁদের উৎপত্তি ব্যাখ্যার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও প্রভাবশালী মডেল—যাকে বলা হয় Giant Impact Hypothesis। তবে এখনও অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা। বিশেষ করে একটি প্রশ্ন বহুদিন ধরেই বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে—থেইয়া কোথা থেকে এসেছিল?
3
10
সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক নতুন গবেষণা এই রহস্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ উন্মোচন করেছে। পৃথিবীর শিলা, উল্কাপিণ্ড এবং চাঁদ থেকে আনা নমুনার রাসায়নিক গঠন বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা থেইয়ার “ভূতের মতো” অবশিষ্টাংশের সন্ধান পেয়েছেন। তাদের ফলাফল বলছে—পৃথিবী ও থেইয়া একই ধরনের মহাজাগতিক উপাদান থেকে তৈরি হয়েছিল।
4
10
এই আবিষ্কার ব্যাখ্যা করে কেন চাঁদের শিলার রাসায়নিক গঠন পৃথিবীর ম্যান্টলের সঙ্গে এত মিল। যদি থেইয়া ও পৃথিবী একই স্থানের ধূলিকণা ও গ্যাস থেকে জন্ম নিয়ে থাকে, তাহলে তাদের সংঘর্ষে তৈরি চাঁদের গঠনও স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর মতো হবে। অর্থাৎ পৃথিবী ও থেইয়া দু’জনেই সূর্যের কাছাকাছি, অভ্যন্তরীণ সৌরজগৎ–এই অঞ্চলের উপাদান থেকে তৈরি।
5
10
বহু তত্ত্ব আছে চাঁদের উৎপত্তি নিয়ে, কিন্তু থেইিয়া-তত্ত্বই এখনও শক্তিশালী ব্যাখ্যা দেয়। গবেষক নিকোলাস ডফাসের ভাষায়, তখনকার সৌরজগৎ ছিল যেন মহাজাগতিক বিলিয়ার্ড খেলা—একটি গ্রহ আরেকটি গ্রহের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে গড়ে উঠছে, বদলে যাচ্ছে। বিশাল আকারের সংঘর্ষ সেই সময়ে ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা। পরে এগুলোর সংখ্যা কমে আসে, কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। পৃথিবী শুধু একটু দেরিতে একটি বড় আঘাত পেয়েছিল।
6
10
তবে একটি বড় সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীদের বিরক্ত করছিল। কম্পিউটার সিমুলেশন দেখায় যে সাধারণত এমন সংঘর্ষে যে চাঁদ তৈরি হয় তার বেশিরভাগ অংশ আসে আঘাতজনিত বস্তু—থেইয়া—থেকে। কিন্তু আসলে চাঁদের রাসায়নিক গঠন পৃথিবীর ম্যান্টলের সঙ্গে প্রায় অভিন্ন। এটা কিভাবে সম্ভব?
7
10
নতুন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা নজর দেন লোহার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ওপর। পৃথিবী যখন গঠিত হচ্ছিল, তখন ভেতরের ভারী লোহা কেন্দ্রে নেমে গিয়ে তৈরি করে আজকের পৃথিবীর কোর। কিন্তু পৃথিবীর ম্যান্টলে আজও প্রচুর পরিমাণ লোহা পাওয়া যায়, যা প্রথম গঠনের সময় থাকা সম্ভব ছিল না। বিজ্ঞানীদের মতে, এই লোহার অনেকটাই এসেছে পরে—বিশেষ করে থেইয়ার মতো কোনো বৃহৎ বহিরাগত বস্তুর আঘাতে।
8
10
গবেষকেরা দেখেছেন—পৃথিবীর ম্যান্টল, চাঁদের শিলা এবং থেইয়া-উৎপন্ন উপাদানের লোহার আইসোটোপিক বৈশিষ্ট্য প্রায় হুবহু একই। আরও চমকপ্রদ হলো—এগুলো আবার মিলেছে এমন উল্কাপিণ্ডের সঙ্গে, যেগুলোকে বলা হয় non-carbonaceous chondrites—যেগুলো সূর্যের খুব কাছাকাছি অঞ্চলে গঠিত হয়েছিল। অর্থাৎ পৃথিবী ও থেইয়া দু’জনেই সূর্যের উষ্ণ আঁচে জন্ম নেওয়া উপাদান থেকে তৈরি।
9
10
এছাড়া পৃথিবীতে একটি বিশেষ ধরনের নাক্ষত্রিক উপাদান অস্বাভাবিক মাত্রায় পাওয়া যায়, যা সূর্যের আরও কাছে গঠিত বস্তুর বৈশিষ্ট্য। বিজ্ঞানীদের ধারণা—এই অতিরিক্ত “নাক্ষত্রিক মসলা”ও এসেছে থেইয়া থেকে। অর্থাৎ থেইয়া সম্ভবত পৃথিবীর চেয়েও সূর্যের আরও কাছে গঠিত হয়েছিল।
10
10
এই আবিষ্কার আমাদের চাঁদ ও পৃথিবীর ইতিহাস বোঝার পথে আরেক ধাপ এগিয়ে দিল। মহাজাগতিক সংঘর্ষের সেই ভয়ংকর মুহূর্ত আজও আমাদের গ্রহ ও চাঁদের হৃদয়ে রয়ে গেছে রাসায়নিক স্মৃতি হয়ে।