ওটিটি-র আয়নায় বাস্তবের পাঁচ নৃশংস অপরাধীর জীবন। ‘গণশত্রু- বাংলার আতঙ্ক’ দেখে লিখছেন পরমা দাশগুপ্ত।
কিছু কিছু অপরাধ মানুষের মনে চিরতরে দাগ কেটে যায় তার হাড়হিম করা নৃশংসতায়। কিছু কিছু অপরাধী দাপুটে পুলিশ-গোয়েন্দারও বুক কাঁপিয়ে দেওয়া কিংবা ক্রিমিনাল সাইকোলজিরই ভিত নড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে তার ঠান্ডা মাথার, বিকৃত অপরাধমনস্কতায়। পুলিশের কেস ডায়েরি থেকে আদালতের রায়, মনস্তাত্ত্বিকের গবেষণা থেকে আমজনতার স্মৃতি, সর্বত্র আজও একই রকম সাড়াজাগানো এমন পাঁচ কুখ্যাত অপরাধীর কাহিনি নিয়ে সদ্য জি ফাইভে মুক্তি পেয়েছে ‘গণশত্রু- বাংলার আতঙ্ক’।
সিরিজের পাঁচ পর্বে পাঁচটি গল্প নিয়ে হাজির হয়েছেন পাঁচ পরিচালক—শমীক রায়চৌধুরী, অভিরূপ ঘোষ, মধুরা পালিত, সায়ন দাশগুপ্ত এবং শ্রীমন্ত সেনগুপ্ত। গল্প নয়, ঘোর বাস্তব। একেবারে ছাপোষা সাধারণ মানুষ থেকে গা শিউড়ে দেওয়া অপরাধীর জন্ম, সেই গণশত্রুদের অপরাধ-জীবন, পুলিশি তদন্ত, টানটান উত্তেজনায় ঠাসা গ্রেফতার পর্ব এবং সাজা ঘোষণা- পুরো সফরটাই উঠে এসেছে কখনও নাট্যরূপে, কখনও বা বেঁচে ফেরা ভিকটিম আর গুপ্তচরের জবানি, পুলিশ আর সাংবাদিকের আঁখো দেখা খতিয়ান, মনস্তত্ত্ববিদের ব্যাখায়। আর এই পুরো প্যাকেজটাতেই আর পাঁচটা সিরিজের থেকে এক্কেবারে আলাদা স্বাদে মন কাড়ছে এই ডকু সিরিজ।
সজল বাড়ুইকে মনে পড়ে? বাবা, সৎমা, সৎ দাদার মারধর, অশান্তির বদলা নিতে বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে ঠান্ডা মাথায় তাদের খুন করেছিল ষোলো বছরের ছেলে। শুধু তাই নয়, মিথ্যে হানাদারদের গল্প সাজিয়ে স্নায়ুর জোরে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিল দুঁদে পুলিশ অফিসারদেরও। কিংবা চেনম্যান? যে বিকৃতমনস্ক সিরিয়াল কিলারের হাতে লাগাতার পাঁচ বছর প্রাণ হারিয়েছিল কালনার একের পর এক গৃহবধূ-কিশোরী। মাথায় বাড়ি মেরে, গলায় চেন জড়িয়ে খুনের পর মৃতদেহকে ধর্ষণ করে যে সম্ভবত সামনে এনেছিল এ রাজ্যের প্রথম নেক্রোফিলিয়ার নজির। উনিশ শতকে ভারতের প্রথম সিরিয়াল কিলার, সোনাগাছির দেহপসারিণী ত্রৈলোক্যতারিণীও ঘুম কেড়েছিল তৎকালীন দাপুটে দারোগা প্রিয়নাথ মুখুজ্জের। তাঁর বই ‘দারোগার দপ্তর’-এ সবিস্তার রয়েছে ত্রৈলোক্য কীভাবে অর্থবান বাবুদের ঠকিয়ে কিংবা সোনাগাছি-চিৎপুরের মেয়েদের খুন করে ভরিয়ে তুলছিল নিজের টাকা-গয়নার ভাণ্ডার। বৌবাজার বিস্ফোরণের মূল কাণ্ডারী, সাট্টা কিং রাশেদ খানের রাজপাট কিংবা একদা মহেশতলার ত্রাস হুব্বা শ্যামলের রক্তের নেশার কথাও কি মানুষ ভুলতে পেরেছে?
আজও শিরদাঁড়া দিয়ে হিমেল স্রোত বইয়ে দেওয়া এই পাঁচ জনই তাই জায়গা করে নিয়েছে সিরিজে। বলিষ্ঠ পরিচালনা, নিখুঁত রিসার্চ, সিনেম্যাটোগ্রাফির ডিটেলিং, নির্মেদ সম্পাদনা যার স্বাদ বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকটাই। আর অভিনয়? দেখতে বসে যেন সত্যিই দর্শককে একটানে তৎকালীন বাস্তবে নিয়ে গিয়ে ফেলেন প্রত্যেকেই। কিশোর সজল বারুইয়ের শীতল চাহনি কোন মন্ত্রবলে যে আয়ুষ দাসের চোখে উঠে আসে! হেরো মানুষদের দলে থাকা কামরুজ্জামান সরকারের চেনম্যান হয়ে ওঠাকে অনায়াসে ফুটিয়ে তোলেন দেবপ্রিয় মুখোপাধ্যায়। দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাশেদ খানের জুতোয় অবলীলায় পা গলিয়ে দেন সুব্রত দত্ত। আর শ্যামল দাসের হুব্বা শ্যামল হয়ে ওঠাকে এক্কেবারে জীবন্ত করে পর্দায় হাজির করেন রুদ্রনীল ঘোষ।
তবে কাজটা শক্ত ছিল পাওলি দাম এবং কিঞ্জল নন্দের। কারণ বাকিদের কাহিনি কিংবা চেহারা সবটাই জানা, খবরের কাগজ, পুলিশ ফাইল কিংবা আদালতের রায় থেকে সবটাই স্পষ্ট। কিন্তু ত্রৈলোক্যতারিণী বা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় এ যুগের মানুষ নন। তবু তাঁদের কাল্পনিক অস্তিত্বকে ভীষণ ভাবেই জীবন্ত করে তোলেন পাওলি দাম এবং কিঞ্জল নন্দ। কোথাও এতটুকুও টাল খায়না সেই ছবি। তাই কিছুটা বাড়তি হাততালি নিশ্চিত ভাবেই তাঁদের প্রাপ্য। পার্শ্বচরিত্রেও আলাদা করে চোখ টানেন সঞ্জীব সরকার, সুব্রত গাঙ্গুলি, ছন্দক দত্ত-সহ প্রায় প্রত্যেকেই।
তবে সাংবাদিক, পুলিশ, মনোবিদ, ভিক্টিম কিংবা পুলিশের ‘খবরি’দের ভাগ করে নেওয়া তথ্য আরও অনেকখানি সমৃদ্ধ করে তুলেছে সিরিজকে। দর্শক পৌঁছে যেতে পেরেছেন বাস্তবের আরও কাছাকাছি। আজও পিছু ফিরে দেখতে গিয়ে তৎকালীন পুলিশ অফিসারদের কেঁপে ওঠা দর্শককে বুঝিয়ে ছেড়েছে ঠিক কতখানি ভয়ঙ্কর ছিল বাস্তবের মানুষগুলো কিংবা কতটা নৃশংস ছিল ক্রাইম সিন। এটা নিঃসন্দেহে এ সিরিজের মাস্টারস্ট্রোক।
তবে হ্যাঁ আলোড়ন ফেলা এই প্রত্যেকটা চরিত্র, তাদের অপরাধ জীবনের প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি সে সময়ের সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে হয়তো আজও পুরোপুরি মনে আছে অনেকেরই। এ সিরিজ যে তার বাইরে প্রচুর নতুন তথ্য বার করে আনতে পেরেছে, এমনটা নয়। তবে বাস্তবের সেই ঘটনাগুলোকে নাট্যরূপে হলেও বাড়তি নাটকীয়তা ছাড়া চাক্ষুষ দেখার সুযোগ, পুলিশ-সাংবাদিকদের অনুভূতিগুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়া, সেটা কম নাকি!
