দেশবিদেশের ফেস্টিভ্যাল পেরিয়ে এবার ওটিটি-তে ‘স্টোলেন’। কতটা মন কাড়ল করণ তেজপালের প্রথম ছবি? লিখছেন পরমা দাশগুপ্ত।
২০১৮-র আসাম। হোয়্যাটসঅ্যাপে ভাইরাল হওয়া মিথ্যে খবরের জেরে ছেলেধরা সন্দেহে গণপ্রহার। প্রাণপণ ক্ষমাভিক্ষা করেও রেহাই মেলেনি। গ্রামবাসীরা পিটিয়ে মেরে ফেলে দুই ভাই নীলোৎপল দাস এবং অভিজিৎ নাথকে। বাস্তবের সেই গা শিউরে ওঠা ঘটনা অবলম্বনেই পরিচালক করণ তেজপালের প্রথম ছবি ‘স্টোলেন’। দেশবিদেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসা কুড়িয়ে যা সদ্য মুক্তি পেয়েছে অ্যামাজন প্রাইমে।
পর্দার গল্পে দুই ভাই গৌতম (অভিষেক ব্যানার্জি) এবং রমন (শুভম বর্ধন)। মায়ের বিয়েতে যোগ দিতে বাড়ি ফেরার ফ্লাইট মিস করে ট্রেন ধরে পেশায় ফ্রিল্যান্স ফোটোগ্রাফার রমন। সেই ট্রেন তুমুল লেট। মাঝরাতে তাই রাজস্থানের প্রত্যন্ত গ্রামে ছোট্ট স্টেশনের বাইরে ঝাঁ-চকচকে এসইউভি নিয়ে অপেক্ষায় দাদা গৌতম। ইতিমধ্যে প্ল্যাটফর্মে ঘুমন্ত পরিযায়ী শ্রমিক ঝুম্পার (মিয়া মায়েলজ়ার) পাশ থেকে তার পাঁচ মাসের একরত্তি সন্তান চম্পাকে নিয়ে পালায় কেউ। সদ্য ট্রেন থেকে নেমেই রমন জড়িয়ে পড়ে গোলমালে। মেয়েকে হারিয়ে বিধ্বস্ত ঝুম্পা তাকেই ছেলেধরা সন্দেহ করে বসে। শেষমেশ জেরায় পুলিশ বোঝে রমনের দোষ নেই। এদিকে, প্ল্যাটফর্মেরই চায়ের দোকানির শিশু চুরির এক চক্রে জড়িত থাকার ইঙ্গিত মেলে। জানা যায়, চম্পার সম্ভাব্য গন্তব্যও। সুন্দরবনের দেহাতি মেয়ে ঝুম্পাকে সাহায্য করতে টালবাহানা করতে থাকে পুলিশ।
মানবিকতার খাতিরে অসহায় ঝুম্পার পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে যায় রমন-ই। টাকাপয়সা দিয়ে ঝুটঝামেলা থেকে রেহাই পেতে চাওয়া গৌতমের হাজার আপত্তি, সাবধানবাণীর তোয়াক্কা না করেই। বিপদের গন্ধ পেয়ে ভাইকে একা ফেলে যেতে মন চায়না গৌতমেরও। অগত্যা গাড়িতে চম্পাকে তুলে দুই ভাই ছোটে হারানো একরত্তির খোঁজে। এসবের মাঝেই কারা যেন প্ল্যাটফর্মের গোলমালের ভিডিও তুলে ভাইরাল করে দেয়। সঙ্গে মিথ্যে গুজব, দুই ভাই আর চম্পাই নাকি বাচ্চা চুরি করে পালাচ্ছে এসইউভি-তে। সে খবর দাবানলের মতো ছড়িয়েও পড়ে আশপাশের গ্রামে। ফলে গাড়ির পিছু নেয় উন্মত্ত জনতা। তারপর রাতভর রুদ্ধশ্বাস ছুট। মারমুখী জনতার হাত থেকে কি প্রাণ বাঁচবে তিন জনের? ছোট্ট চম্পা কি শেষমেশ ফিরবে মায়ের কোলে? তা নিয়েই এগিয়েছে ছবির গল্প।
দেড় ঘণ্টার টানটান, মেদহীন চেজ ড্রামায় সিনেমাটোগ্রাফি লার্জার দ্যান লাইফ নয়, বরং বাস্তব ঘেঁষা। বালিয়াড়ি ঘেরা এবড়োখেবড়ো পথ, ধুধু প্রান্তর, জঙ্গল, প্রত্যন্ত গ্রাম পেরিয়ে গাড়ি ছোটার দৃশ্যগুলো কোথাও কোথাও খানিক কাঁচা হাতের কাজ বলে তকমা দিতে পারেন কেউ কেউ। তবে তাতে বরং সেগুলো আরও খানিক জীবন্তই ঠেকে। আরও দমবন্ধ করে দর্শক অপেক্ষায় থাকেন দুই ভাই ও চম্পার পরিণতির। ভাল লাগে ফ্ল্যাশব্যাকের লোভ সম্বরণ করে স্রেফ কথোপকথনের হাত ধরে দুই ভাইয়ের পারিবারিক পরিচয়, তাদের অতীত, দু’জনের সম্পর্ক কিংবা ঝুম্পার লুকোনো সত্যি দর্শকের মনে গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা। বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আবেগ-বাস্তবতার দোলাচল আর টানাপোড়েনে ঝুম্পার সঙ্গে দুই ভাইয়ের এক অব্যক্ত মায়ার বাঁধনও বড্ড মন কাড়ে।
আর ভাল লাগে অভিনয়। সেই ‘হাতোড়া ত্যাগী’র নৃশংস অবতার থেকে এ ছবির এক আদ্যন্ত শহুরে, বাস্তববাদী গৌতম- এবারেও অভিষেক চোখ ধাঁধিয়ে দেন অনায়াস অভিনয়ের বলিষ্ঠতায়। কোমল মনের, বিবেকবান রমনকে পাল্লা দিয়ে যত্নে বোনেন শুভমও। পাঁচ মাসের মেয়েকে হারিয়ে ফেলে মানসিক ভাবে ভেঙেচুরে যাওয়া ঝুম্পা থেকে যে কোনও মূল্যে তাকে ফিরে পেতে, দুই সাহায্যকারীকে আগলে রাখতে মরণপণ করা সাহসিনী- এই পুরো সফরটাকে নিজের অভিনয়গুণে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলেন মিয়া। উপকারী পুলিশ অফিসার পণ্ডিতজীর ভূমিকায় চোখ টানেন হরিশ খান্নাও।
যদিও বড় তাড়াহুড়ো করে শেষ হয়ে যায় ছবিটা। আর তাই খানিক খাপছাড়াই ঠেকে রুদ্ধশ্বাস ছুটের শেষ প্রান্ত। তাড়া করা বা গণপিটুনির দৃশ্যগুলোয় যতটা দর্শককে টেনে রাখার চেষ্টা চোখে পড়ে, শিশুচুরির মতো অপরাধের দিকটায় ততখানি মনোযোগ থাকা জরুরি ছিল। বড্ড অনায়াসে যেন সবটা খাপে খাপ মিলে যায়। আর থেকে যায় কিছু ছোট ছোট প্রশ্ন। যেমন, দাদার আপত্তি সত্ত্বেও ঠিক কী কারণে রমন এতটা ঝুঁকি নিতে এগোয়, কেন নিজের অতীত নিয়ে এত বিপন্ন ঝুম্পা, অথবা সুন্দরবনের বাঙালি মেয়ের সঙ্গে দিল্লিবাসী গৌতম এত ঝরঝরে বাংলায় কথা বলে কেন- এসবের উত্তরগুলো থাকলে মন্দ হত না। তবে রমন যেভাবে ঝুম্পার সহায় হয়ে ওঠে, প্রখর বাস্তববাদী গৌতমেরও যেভাবে মানবিকতায় উত্তরণ ঘটে যায়, তাতে অনেকটা আলো মেখে থাকে। পর্দার বাইরের এই আত্মসুখী, আত্মসর্বস্ব, হিসেব কষা দুনিয়ায় সেই আলোটাই তো প্রাপ্তি। পর্দা ফুঁড়ে সেই ভাললাগার রেশ মনের ভিতর থেকে যায় বহুক্ষণ। সেটা কম নাকি!
