কেমন হয় মাত্রাছাড়া প্রেমের পরিণতি? নতুন সিরিজ ‘বাতাসে গুনগুন’-এ তারই উত্তর খুঁজলেন পরমা দাশগুপ্ত।  

 

 

প্রেম হতেই পারে। উথালপাথাল সেই প্রেমে মনে হতেই পারে যে কোনও মূল্যে পেতেই হবে মনের মানুষকে। কিন্তু সেই বেলাগাম ভালবাসা যদি উল্টোদিকের মানুষটার জীবনটাকেই ওলটপালট করে দেয়? তছনছ করে দিতে চায় তার পৃথিবী? সেই নাছোড় আকাঙ্ক্ষা কেমন করে অসুখের আকার নেয়, তারই গল্প বলেছে ‘বাতাসে গুনগুন’— হইচইয়ের নতুন সিরিজ।

 

 

 

 

চারপাশের সমাজে এমনিতেই এখন অসহিষ্ণুতার ছড়াছড়ি। পারিবারিক বাঁধন থেকে পেশাগত সম্পর্ক, বন্ধুত্ব থেকে প্রেম— সবই তার গ্রাসে। কাউকে ভাল লাগে মানে তাকে পাওয়া চাই। তার ভাল লাগুক বা না লাগুক, সে সম্পর্কে বাঁধা পড়তে চায় কি চায় না, তাতে থোড়াই কেয়ার। আর সেই জেদকে যদি বলীয়ান করে তোলে রাজনৈতিক ক্ষমতা বা পেশীশক্তি, তবে তো কথাই নেই। ইদানীং প্রেমের নামে এমন আনহেলদি অবসেশনের উদাহরণ ভুরি ভুরি ছড়িয়ে চারপাশে। তাতেই আয়না ধরতে চেয়েছেন পরিচালক অরিজিৎ টোটন চক্রবর্তী। 

 

 

 

 

গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে ধনীর দুলালি পল্লবী পট্টনায়ক (সৃজলা গুহ)। একাধারে রাজনৈতিক প্রতিপত্তি আর চোরাকারবারের রমরমার দাপটে তার কাকা প্রকাশ পট্টনায়কের (শিলাজিৎ মজুমদার) কথায় ওঠেবসে গোটা হলদিপুর। যোগ্য সঙ্গত দেন পল্লবীর বিধবা মা তথা প্রকাশের প্রেমিকা (ময়না মুখার্জি)। এদিকে পল্লবী তার কাকার পথের কাঁটাও বটে। ভাইঝির কলেজে ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান প্রকাশ। তাই পল্লবীকে সমঝে চলে গোটা ক্যাম্পাস। হলদিপুরের সেই কলেজেই প্রফেসর হয়ে আসে অরিন্দম (সুহোত্র মুখোপাধ্যায়)। ক্যানসারে আক্রান্ত মাকে স্ত্রী মিথিলার (মানালি মনীষা দে) দায়িত্বে নিজের শহরে রেখে। 

 

 

 

 

এ সবের মাঝেই সুন্দরী পল্লবীর সঙ্গে চোখাচোখি থেকে ভাললাগার শুরু। কলেজে উন্নতির আশায় তাকে খানিকটা আশকারাই দিয়ে ফেলে অরিন্দম। জানত না সেটাই কাল হয়ে দাঁড়াবে। অরিন্দমের প্রেমে পাগল পল্লবী তার কাকার ক্ষমতা আর বাবার আমলের বলভরসা ‘মুন্নাদা’র (দেবজ্যোতি রায়চৌধুরী) জোরে অরিন্দমকে প্রায় খেলার পুতুল বানিয়ে ছাড়ে। এমনকী সে বিবাহিত জেনে আরও নাছোড় হয়ে দাঁড়ায় মেয়ের জেদ। ছাত্রীর এমন অবসেশন কোন পথে ঠেলে দেবে অরিন্দমের জীবন আর তার দাম্পত্যকে? এই নাগপাশ থেকে কি মুক্তি পাবে সে? পল্লবীর জন্যই বা অপেক্ষায় আছে কোন পরিণতি? তারই হদিশ দিয়েছে সাত পর্বের সিরিজ।

 

 

 

 

মুশকিল হল, ঠিক একই ধাঁচের গল্প ইতিমধ্যেই আগে দেখে ফেলেছেন দর্শক। কিছুদিন আগের হিন্দি সিরিজ ‘ইয়ে কালি কালি আঁখে’র কাহিনি হেঁটেছিল প্রায় একই পথ ধরে। ত্রিকোণ প্রেম থেকে জেদ হয়ে ওঠা সম্পর্কের গল্পও বলিউড থেকে টলিউডে, সিনেমা কিংবা সিরিজে নেহাত কম নয়। তাই এ জায়গাটায় তেমন নতুন কিছুর স্বাদ এনে দিতে পারেনি অরিজিতের সিরিজ। পাশাপাশি নাছোড় প্রেমের গল্পে রাজনীতি-চোরাকারবারের আঁধার দুনিয়া, পুলিশি দুর্নীতির প্লট আর থ্রিলারের গন্ধ বুনে দিতে গিয়ে কেমন যেন খেই হারানো হয়ে দাঁড়িয়েছে গল্প। প্রকাশের উত্থান, পল্লবীর পারিবারিক সমীকরণ, মুন্নার অতীত কিংবা পল্লবীর সঙ্গে তার আনুগত্যের সম্পর্কটাকে আর একটু গভীরে গিয়ে জানার সুযোগ পেলে মন্দ হত না। কিন্তু এই সমস্ত সাব প্লটগুলোকেই স্রেফ উপর উপর ছুঁয়ে গিয়েছে সিরিজের কাহিনি। তার উপরে শেষ দুটো পর্বে একের পর এক ট্যুইস্ট খানিকটা ওভারডোজের মতোই ঠেকে।     

 

 

 

   

তবে প্রেম থেকে বেলাগাম অবসেশনের পথে হাঁটা পল্লবীকে অভিনয়ে, চোখের ভাষায়, অভিব্যক্তিতে খুব বিশ্বাসযোগ্য করে ফুটিয়ে তুলেছেন সৃজলা। সিরিজের শুরুর দিকে অরিন্দমকে ঘিরে পল্লবীর চাওয়াপাওয়ার মুহূর্তগুলো তাই ভাল লাগে বেশ। সুহোত্র বা মানালি বরাবরই দাগ কাটেন তাঁদের অভিনয়ের বলিষ্ঠতায়। দাম্পত্যের মিষ্টি মুহূর্ত থেকে পল্লবীর প্রেমের ফাঁসে অসহায় দিনযাপনের সময়গুলো— সবেতেই ভারী জীবন্ত লাগে দু’জনকে। অরিন্দমের বন্ধু-সহকর্মী সায়নের চরিত্রে দুর্বার শর্মাও বেশ নজর কাড়েন। প্রতিপত্তির দৃশ্যায়ন আর পারিবারিক রাজনীতির ছোট্ট পরিসরে তেমন কিছু করার ছিল না শিলাজিৎ বা ময়নার। ঠিক যেমন মুন্নার সংক্ষিপ্ত উপস্থিতিতে অভিনয়ের জোরে দাগটুকু কাটা ছাড়া কিছু করার ছিল না দেবজ্যোতিরও। ইদানীং একের পর এক খল চরিত্রে যাঁর তুখোড় অভিনয় মন কাড়ছে দর্শকের।  

 

 

 

 

প্রাপ্তি হয়ে রইল অবশ্য গান। এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় গান ‘বাতাসে গুনগুন’কে সিরিজের সিগনেচার হিসেবে ব্যবহার এক আলাদা মাত্রা যোগ করেছে গল্পে। সিরিজ শেষের পরেও খানিকক্ষণ তা গুনগুন করতে আপনি বাধ্য!