ঋষভ শেঠির ‘কান্তারা: আ লেজেন্ড – চ্যাপ্টার ১’ স্রেফ এক সিনেমা নয়, এক রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। লোকবিশ্বাস, ভক্তি, ক্ষমতা আর লালসার সংঘর্ষে তৈরি এই গল্প যেন যুগ যুগান্তরের প্রতিধ্বনি। ‘কান্তারা (২০২২)’ যে আধ্যাত্মিক উন্মাদনা তৈরি করেছিল, এই প্রিকুয়েল সেটাকে আরও গভীর, আরও রহস্যময় স্তরে নিয়ে গেল।

 

এ ছবির গল্প এক হাজার বছর আগের!  অনেকটা এরকম - হাজার বছর আগে, দক্ষিণ ভারতের বিরাট, ভয়াল জঙ্গলের গভীরে এক শান্ত জনপদ। নাম কান্তারা। সেখানকার মানুষরা ‘দৈব’ গুলিগা-র আরাধনা করে — এমন এক দেবীয় শক্তি, যার কৃপা ও ক্রোধ দুটোই সমান ভয়ঙ্কর। সেই গ্রামেই বাস 'বর্মে'-র (ঋষভ শেঠি), যিনি প্রকৃতির সন্তান, দৈবের আশীর্বাদপ্রাপ্ত। যাকে শৈশব অবস্থায় এক গুহার মধ্যে কুড়িয়ে পেয়েছিল কান্তারা-র আদিবাসীরা। এমন এক গুহা যেখানে ওই শিশুকে পাহারা দিচ্ছিল জঙ্গলের সবথেকে ভয়ঙ্কর এক নরখাদক বাঘ! 

 

 

 

কান্তারার জঙ্গলের পাশেই রাজ্য বঙ্গরা। রাজা রাজশেখর (জয়রাম) শৈশবে দেখেছিলেন— তাঁর পিতা লোভে পড়ে জঙ্গলের জমি আর দৈবের শক্তি দখল করতে গিয়ে মৃত্যুর মুখে পড়েছিলেন। তাই রাজশেখরের কড়া আদেশ— জঙ্গলে সেনারা ঢুকবে না।কিন্তু তাঁর ছেলে কুলশেখর (গুলশন দেবাইয়া) সিংহাসনে বসেই সেই নিয়ম ছিঁড়ে ফেলে। শিকার করতে ঢোকে জঙ্গলে, আর সেখানেই ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা— সেনারা অনুভব করে দৈবের উপস্থিতি, ভয়ে পালিয়ে যায় সবাই। এদিকে বর্মে রেগে আগুন! সে রাজ্যের ভিতর ঢুকে প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে ওঠে। এই সময়েই তার দেখা হয় রাজকন্যা কঙ্কাবতী (রুক্মিণী বসন্ত)-র সঙ্গে। দু’জনের মধ্যে জন্ম নেয় এক নিষিদ্ধ কিন্তু নির্মল সম্পর্ক। কিন্তু এই প্রেমই কি বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে? না কি ভাগ্যই তাদের একসঙ্গে বেঁধে রেখেছে? এখান থেকেই গল্প মোড় নেয় এমনভাবে, যা দর্শককে শ্বাসরুদ্ধ করে রাখবে।

 

 

পরিচালনা ও চিত্রনাট্য: লোককথা থেকে মহাকাব্য

ঋষভ শেঠি, অনিরুদ্ধ মাহেশ ও শানিল গৌতমের লেখা কাহিনি যেন দক্ষিণ ভারতের মাটির গন্ধে মেশানো এক পৌরাণিক কবিতা। ধর্ম, রাজনীতি, অলৌকিক, প্রেম, যুদ্ধ — সব একসঙ্গে গেঁথে গেছে। এসেছে পুরাণের টুকরো টুকরো কোলাজ যেখানে পরশুরাম থেকে রয়েছে কর্ণাটকের নানান লোককথা, উপকথার ছোঁয়া। এবং রয়েছে ক্লিওপেট্রার মতো চরিত্রেরও স্পষ্ট সাদৃশ্য। 

 

ঋষভের পরিচালনা নিখুঁত ভারসাম্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ছবির বিশাল বাজেট, ঝাঁ চকচকে ভিজ্যুয়াল — সব কিছু থাকলেও গল্পটাই মুখ্য। প্রথমার্ধে বন্দরে রথের উপর দুরন্ত অ্যাকশন যেমন চমকে দেয়, তেমনই দ্বিতীয়ার্ধে জঙ্গল, ভয়াল পশুপাখি, এবং দুরন্ত টুইস্টে গায়ে কাঁটা দেবে। প্রি-ক্লাইম্যাক্সে এমন মোড় আসে, যা আন্দাজ করাই অসম্ভব। আর ক্লাইম্যাক্স? এককথায় অতলান্তিক! ‘পুষ্পা ২’-এ আল্লু অর্জুনের ‘অর্ধনারীশ্বর’রূপকেও বলে বলে গোল দিয়েছেন ঋষভ! ‘কান্তারা (২০২২)’-এর সমাপ্তিকে ছাপিয়ে গিয়েছে এই ছবির শেষ দৃশ্য — সিনেমা হল জুড়ে গর্জে ওঠা করতালির ঝড় সেকথাই প্রমাণ করে।

 

অভিনয়: পর্দা জুড়ে আগুনের ফুলকি ছড়িয়েছেন ঋষভ শেঠি

এককথায়, ঋষভ শেঠি যেন নিজের ভেতরের দৈবকে ছুঁয়ে ফেলেছেন। তাঁর অভিনয়ে একসঙ্গে দেখা যায় ভক্তির উন্মাদনা, ক্রোধের তেজ, আর প্রেমের কোমলতা। রুক্মিণী বসন্তের কঙ্কাবতী চরিত্রে মিষ্টত্ব আর চরম দৃঢ়তা, দুই-ই আছে — যেন আলো-ছায়া-অন্ধকারের মিশেল।গুলশন দেবাইয়া রাজা কুলশেখরের চরিত্রে দুর্দান্ত — একদিকে নির্মম, অন্যদিকে বোকা রাজা, যাকে দেখে একইসঙ্গে ঘেন্না আর মজা দুটোই লাগে। জয়রাম আবারও দারুণ। প্রকাশ থুমিনাদ ও প্রমোদ শেঠি প্রয়োজনে হাসিয়েছেন, আবার যখন প্রয়োজন তখন দর্শককে কাঁদিয়েছেন।

 

ছবির সঙ্গীত ও কারিগরি: যেন এক অনুভূতির মহাযজ্ঞ

বি. অজনীশ লোকনাথের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর যেন দেবতার আহ্বান— ঢাকের তালে, শঙ্খের ধ্বনিতে রক্ত গরম হয়ে যায়। আবহসঙ্গীত যে একটি ছবিকে আরও কত উঁচুতে নিয়ে যেতে পারে এক লহমায়, দর্শককে আষ্টেপৃষ্ঠে আরও বেঁধে ফেলতে পারে, তা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেবে এই ছবি। ‘কান্তারা’ গানটি বিশেষভাবে মন ছুঁয়ে যায়।অরবিন্দ এস. কাশ্যপের সিনেমাটোগ্রাফি চোখ জুড়িয়ে দেয়— ভয়াল বন , রক্ত, আগুনের রঙে তৈরি প্রতিটি ফ্রেম যেন কোনও বড় চিত্রকরের হাতে আঁকা জীবন্ত ছবি। প্রোডাকশন ডিজাইন, কস্টিউম, আর অ্যাকশন দৃশ্য— সব মিলিয়ে চোখ সরানো যায় না।তবে একটাই খটকা, প্রথমার্ধ একটু দীর্ঘ লেগেছে; কিছু গান গল্পের গতি আটকে দিয়েছে। তবুও দ্বিতীয়ার্ধের শক্তি এত প্রবল যে এই ছোটখাটো ত্রুটি স্রেফ ধুলোয় মিশে যায়। এটাও বলা প্রয়োজন, ট্রেলার ছবির মহিমা বোঝাতে পারেনি, তাই মুক্তির আগে তেমন হাইপ তৈরি হয়নি। প্রথম অংশ কিছুটা ছোট হলে আরও ঝরঝরে হত। আবার কয়েকটি দৃশ্যে দৈবর আখ্যান একটু জটিল লেগেছে।


‘কান্তারা: আ লেজেন্ড – চ্যাপ্টার ১’ কেবল একটি চলচ্চিত্র নয় — এটি এক পৌরাণিক গর্জন, যেন এক ধর্মীয় আবেগের জাগরণ। ঋষভ শেঠি এখানে প্রমাণ করেছেন— লোককাহিনি, আধ্যাত্মিকতা আর সিনেম্যাটিক মহিমা একসঙ্গে কীভাবে মিশে যেতে পারে। ক্লাইম্যাক্সের পর নীরবতা নেমে আসে, কিন্তু দর্শকের চোখে জল, গায়ে কাঁটা, আর মনে একটাই প্রশ্ন — “এমন সিনেমা আবার কবে দেখব?”

আজকাল ডট ইন -এর মতে, ‘কান্তারা: আ লেজেন্ড – চ্যাপ্টার ১’ অনায়াসেই তাই (৪.৫/৫) এটা শুধু সিনেমা নয় — এটা যেন এক দৈব ঝড়! আর মুখে মুখে প্রশংসা ছড়ালে বছরের সবচেয়ে বড় ব্লকবাস্টার হতে চলেছে ‘কান্তারা: আ লেজেন্ড – চ্যাপ্টার ১’!

ও হ্যাঁ, ‘কান্তারা: আ লেজেন্ড – চ্যাপ্টার ২’ কিন্তু আসছে এবার। সে ঘোষণাও ছবির একেবারে শেষে দুরন্তভাবে করা হয়েছে। অবশ্য না করেও উপায় কী? কারণ এই ছবির গল্প তো যাকে বলে, ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’!