ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে বিশাল ভরদ্বাজের ‘মকবুল’ (২০০৩) এক অনন্য মাইলফলক। শেকসপিয়রের ম্যাকবেথ-এর ভারতীয় রূপান্তর, যেখানে মুম্বইয়ের আন্ডারওয়ার্ল্ডকে মঞ্চ করে গড়ে উঠেছিল ক্ষমতা, ষড়যন্ত্র আর আবেগের গল্প। নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরী, পঙ্কজ কাপুর, তাব্বু—সবাই ছিলেন এই ছবিতে। কিন্তু ছবির প্রাণ ছিলেন ইরফান খান। তাঁর অভিনয়ের গভীরতা আজও দর্শককে টেনে রাখে।তবে ছবির সাফল্যের মতোই স্মরণীয় তার শুটিংয়ের একটি মুহূর্ত—যেটি সম্প্রতি স্মৃতিচারণ করলেন অভিনেতা দীপক ডোব্রিয়াল।
অভিনেতার কথায়, “এক দৃশ্যে দেখা যায়— ছবিতে পীয়ূষ মিশ্রর চরিত্র খুন হয় এবং তাঁর দেহ আনা হয় ইরফানের বাড়িতে। চারদিকে শোকের আবহ, ইরফান চরিত্র অনুযায়ী ডুবে গেছেন সেই বেদনায়। তখনই সংলাপে আসে ‘হাভেলি’ শব্দটি। কিন্তু ওম পুরী যেভাবে ‘হাভেলি’ উচ্চারণ করছিলেন, সেটি এতটাই মজাদার হয়ে ওঠে যে বারবার হেসে ফেলছিলেন ইউনিট। এমনকী নাসিরুদ্দিন শাহও সেই হাসিতে যোগ দেন। ফলে, একের পর এক টেক নষ্ট হচ্ছিল, অথচ কেউই সাহস পাচ্ছিলেন না ওমজি বা নাসির স্যারের সামনে কিছু বলার।”

“আর এই ক্রমাগত বাধা কিন্তু ইরফানের মনোসংযোগে আঘাত করছিল। তিনি চরিত্রে নিমগ্ন, বিষাদের আবহে ডুবে আছেন—কিন্তু চারপাশের হাসাহাসিতে ভারী দৃশ্য ভেস্তে যাচ্ছে। অবশেষে, আর ধরে রাখতে না পেরে, টেক চলাকালীনই হঠাৎ বিস্ফোরিত হলেন ইরফান। বাছাই করা সব গালাগাল আচমকা বেরিয়ে এল তাঁর মুখ থেকে! এক মুহূর্তের জন্য শুটিং থমকে গেল। গোটা ইউনিট পাথর!”
“কিন্তু এরপর সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু ক্ষমাও চাইলেন। হেসে বললেন— ‘সরি, ভেবেছিলাম গলাগালি দিলে হয়তো আমার অভিনয়টা আরও বেরোবে’। কিন্তু ওই এক মুহূর্তেই সেটের আবহ পাল্টে গেল। কিংবদন্তি ওম পুরী আর নাসিরুদ্দিন শাহ স্তব্ধ। মজা- হুল্লোড় থেমে গিয়ে তৈরি হল এক তীব্র গাম্ভীর্য। তারপরই নেওয়া হল নিখুঁত শট—যা আজও দর্শকের মনে অম্লান। ”
‘মকবুল’ শুধু একটি সিনেমা নয়, বরং ভারতীয় চলচ্চিত্রে শেক্সপিয়রের অনুবাদে এক সংস্কৃতিক বিপ্লব। ইরফান খান তাঁর অভিনয়ে প্রমাণ করেছিলেন—শিল্পী কেবল সংলাপ বলেন না, তিনি চরিত্রে বেঁচে থাকেন। আর এই পর্দার আড়ালের ঘটনা দেখিয়ে দেয়, তিনি কতটা সিরিয়াস ছিলেন তাঁর শিল্প নিয়ে। আজ তিনি নেই। কিন্তু এই গল্পগুলি বারবার মনে করিয়ে দেয়—ইরফান ছিলেন একজন সত্যিকারের শিল্পী, যাঁর রাগও হয়ে উঠেছিল অভিনয়েরই অংশ, আর যাঁর প্রতিটি চরিত্র আজও সমানভাবে আলোচিত সিনেমাপ্রেমীদের মহলে।
