আরও একটা বছর শেষের পথে। নতুন বছরের জন্য কীভাবে, কেমন প্রস্তুতি থাকে সিরিয়াল পাড়ায়? খোঁজ নিলেন পরমা দাশগুপ্ত।
ডিসেম্বরের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে আরও একটা বছর আসতে চলল। আগামী ৩৬৫ দিন ঘিরে এ দিনগুলোয় নানা জল্পনা চলে সব মহলেই। খাবার থেকে বেড়ানো, স্বাস্থ্য থেকে ফ্যাশন— কোথায় কী কী নতুন হবে, জীবনযাপনের সব দিকগুলো নিয়ে আলোচনা-চর্চা এই সময়টায় ওভারটাইম খাটে বরাবরই। বিনোদনই বা বাদ যাবে কেন! যায়ও না। সিনেমা থেকে এখানকার হটস্পট ওটিটি, সামনের বছরটার ঝুলিতে কী কী আছে, তা নিয়ে কৌতূহল তুঙ্গে থাকে বরাবরই। কিন্তু সিরিয়াল পাড়া? বছর শুরুর আগে সেখানে কী কী ঘটে?
সিনেমা, ওটিটি সিরিজ, ইউটিউবের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের কনটেন্ট, সোশ্যাল মিডিয়া রিল— বিনোদনের পসরায় বিকল্প নেহাত কম নয় এখন। তবু টেলিভিশন এবং ধারাবাহিকের নিজস্ব দর্শকের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। তাঁদের কথা ভেবেই নিত্যনতুন গল্প আসে ছোটপর্দায়। ভাল লাগলে চুম্বকের মতো দর্শককে টেনেও রাখে তারা। ইদানীং বাংলা ধারাবাহিকের দুনিয়ায় অবশ্য মাঝেমধ্যেই শুরুর অল্পদিনের মাথায় মেগা সিরিয়াল বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। আগেকার মতো বছরের পর বছর চলার বদলে এক-দেড় বছরের মাথাতেও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে বহু ধারাবাহিক। দুয়েরই নেপথ্যে পড়ন্ত টিআরপি। সে কথা মাথায় রেখে নানা ভাবে নিজেদের কনটেন্টের ধাঁচ বদলে নিচ্ছে সিরিয়াল পাড়াও। বছর শুরুর প্ল্যানেও কি রেশ ফেলছে সেই বদল?
প্রযোজনা সংস্থা অর্গ্যানিঙ্ক স্টুডিয়োজ-এর তরফে অর্ক গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, “আমাদের পাইপলাইনে বেশ কিছু কাজ রয়েছে আগামী দিনগুলোতে। বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে স্বল্প দৈর্ঘ্যের কনটেন্ট, মানে কুড়ি থেকে একশো পর্বের বেশ কিছু গল্পের কাজ চলছে। কিছু থাকছে বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে, বই বা সংবাদমাধ্যম থেকে তুলে আনা সত্যি ঘটনা নিয়ে মোটামুটি একশো পর্বের কাহিনি। আর থাকছে হাল্কা মেজাজের সিটকম ধাঁচের কমেডি ফ্যামিলি ড্রামা। এর মধ্যে সত্যি ঘটনা অবলম্বনে গল্পগুলোর ক্ষেত্রে বেশ কিছু লেখকের সঙ্গে কাজ করছি আমরা। বাকিগুলোর ক্ষেত্রে একটা-দুটো মায়ের (লীনা গঙ্গোপাধ্যায়), আমার নিজেরও আছে। কোনটা কোথায় আসবে, সেটা বিভিন্ন চ্যানেলের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষ। তবে হ্যাঁ, এই কম দৈর্ঘ্যের সিরিয়াল এখনও পপুলার ফর্ম্যাট নয়। টেলিভিশন এখনও আগের মতো মেগা ধারাবাহিকেই বেশি স্বচ্ছন্দ। কারণ একটা সিরিয়াল এক-দেড় বছর চললে সেটা ব্যবসায়িক দিক বা প্রচারের দিক থেকেও লাভজনক।"

অর্ক নিজেদের বার্ষিক কনটেন্ট প্ল্যানের আভাস দিলেও আর এক নতুন প্রযোজনা সংস্থা নিনি চিনি’জ মাম্মা-র তরফে নীলাঞ্জনা শর্মা অবশ্য কিছুতেই কিছু ফাঁস করতে চাইলেন না। “নতুন বছরের পাইপলাইনে অবশ্যই কিছু প্রোজেক্ট রয়েছে। তবে যতক্ষণ না সবকিছু ঠিকমতো মেটিরিয়ালাইজ করছে, ততক্ষণ এ নিয়ে কিছু জানাতে চাইনা,” বলছেন তিনি। তাঁদের নতুন ধারাবাহিকে কিন্তু নতুন ধাঁচের কোনও গল্প কিংবা নতুন কোনও মুখকে দেখা যাবে? নীলাঞ্জনা তা নিয়েও পুরোপুরি মুখে কুলুপ এঁটে।
হাজার ভাবনাচিন্তা, পরিকল্পনা, আলোচনা, পরিশ্রম পেরিয়ে তৈরি হয় একেকটা ধারাবাহিক। শুরুর অল্পদিনেই তা মুখ থুবড়ে পড়লে সবটাই মাটি। নতুন বছরের পাইপলাইন বা প্ল্যান তৈরির সময়ে এই ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলার ভাবনাও কি তবে মাথায় থাকে।
বাংলা টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে দীর্ঘদিনের প্রযোজক স্নিগ্ধা বসু। তাঁর সংস্থা অ্যাক্রোপলিস এন্টারটেনমেন্ট-এর তরফে বললেন, “পরীক্ষা দিতে বসার সময়ে কেউই ভাবে না সে নম্বর কম পাবে বা ফেল করবে। সেই একই কথা সিরিয়ালের ক্ষেত্রেও খাটে। একটা শো ক’দিন চলবে, বন্ধ হয়ে যাবে কিনা— সিরিয়াল শুরুর সময়ে এই ভাবনাগুলো থাকেনা কারওরই। ফলে একটা সিরিয়াল বন্ধ হয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় পাইপলাইনে আরেকটা সিরিয়াল কেউই রাখে না। প্রত্যেকটা ধারাবাহিকের সাফল্য বা ব্যর্থতারই ভাগীদার তিনটে দল- ফ্লোর মানে আর্টিস্ট এবং ক্রু, প্রযোজন সংস্থা এবং চ্যানেল বা প্ল্যাটফর্ম। তাই একটা সিরিয়াল যখন শুরু হয়, প্রত্যেকেরই লক্ষ্য থাকে তাকে যতদূর সম্ভব এগিয়ে নিয়ে চলা। কারণ কাজ এবং রোজগার, সব দিক থেকে সকলেরই লাভ তাতে। সিরিয়াল বন্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে মাপকাঠি হয়ে গিয়েছে টিআরপি (বার্ক)। কিন্তু বার্ক আজ অবধি কত জায়গায় পৌঁছেছে, ঠিক কোন কোন ক্ষেত্রের উপর নির্ভর করে সেই মাপকাঠির হিসেব কষা হয়, আমার মনে হয় না আজও কেউ তা সঠিক বলতে পারবে। তা ছাড়া কোন স্লটে, কখন সিরিয়ালটা চলছে, তার উপরেও নির্ভর করে কত দর্শক দেখছেন। টিআরপি-র হিসেব তার সঙ্গেও জড়িয়ে। ফলে তার সঙ্গেও লড়তে হয়, তার উপরেও মার্কেটিং বা বিজ্ঞাপন নির্ভর করে। আরও একটা বিষয় হল দর্শকের কাছেও এখন অঢেল অপশন। শুধু টিভির পর্দাই এখন রোজকার বিনোদনের একমাত্র উপায় নয়। অনেকে হয়তো সিরিয়ালটাই দেখছেন, কিন্তু মোবাইল বা ল্যাপটপে। টিভির রেটিংয়ে সেটা ধরা হয়না। তবু এই মানদণ্ড অনুসারে চলাটাই দস্তুর। ফলে টিআরপি কম হলে সিরিয়াল বন্ধ করতে বাধ্য হয় চ্যানেল। এর কমব্যাট প্ল্যান এখনও কেউ ভাবেনি। এই মাপকাঠিগুলো বদলাতে পারলে হয়তো পরিস্থিতি বদলাতেও পারে। তবে এখনও প্রত্যেকটা ধারাবাহিক শুরু হয় অনেকদিন চলার আশা বুকে নিয়েই।”
ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো অনেক ক্ষেত্রে বছর শেষেই জানিয়ে দেয়, আগামী বছরে কী কী নতুন রয়েছে তাদের ঝুলিতে। দর্শকও সেই মতো অপেক্ষায় থাকেন একরাশ প্রত্যাশা নিয়ে। রেটিং ঘিরে অনিশ্চয়তা কাটাতে কিংবা নতুন শো ঘিরে দর্শকের আগ্রহ আগেভাগে উস্কে দিতে ধারাবাহিকের ক্ষেত্রেও কি এমনটা করা সম্ভব?
প্রযোজনা সংস্থা এসভিএফ-এর জনসংযোগ ও বিপণন বিভাগের তরফে অহনা কাঞ্জিলাল দত্ত বলেন, “ওটিটি-তে এটা করা যায়। কারণ নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের কনটেন্ট কবে আসবে, কবে শেষ হবে, সেটা আগে থেকে ঠিক করা রয়েছে। কিন্তু সিরিয়ালের ক্ষেত্রে তা একেবারেই সম্ভব নয়। কারণ একটা নতুন ধারাবাহিক আনার সময়ে কারওরই জানা থাকে না তা রেটিং কেমন দেবে কিংবা তা কতদিন চলবে। ফলে তার পরে কবে কোন ধারাবাহিক নতুন শুরু হবে, সেটাও আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।”
