আজকাল ওয়েবডেস্ক: মার্কিন কোম্পানি ইনভেন্টউড সম্প্রতি এমন এক ধরনের কাঠ তৈরি করেছে, যা শক্তি-ওজন অনুপাতে স্টিলের তুলনায় প্রায় দশগুণ বেশি শক্তিশালী এবং একই সঙ্গে ছয়গুণ পর্যন্ত হালকা। এই নতুন প্রজন্মের উপাদানটির নাম “সুপারউড”, যা ইতিমধ্যেই বাণিজ্যিকভাবে বাজারে এসেছে। প্রকল্পটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিখ্যাত উপাদান বিজ্ঞানী লিয়াংবিং হু।
প্রায় এক দশক আগে, মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সময় হু কাঠকে নতুনভাবে কল্পনা করার উদ্যোগ নেন। তিনি প্রস্তাব করেন কাঠের প্রাকৃতিক উপাদান লিগনিন যা কাঠকে রঙ ও শক্তি দেয়—এর একটি অংশ অপসারণের মাধ্যমে কাঠকে পুনঃপ্রকৌশল করার একটি প্রক্রিয়া। তার লক্ষ্য ছিল কাঠের প্রধান উপাদান সেলুলোজ-এর মাধ্যমে কাঠকে আরও মজবুত ও টেকসই করে তোলা। সেলুলোজ হল উদ্ভিদের তন্তু গঠনের মূল উপাদান এবং পৃথিবীর অন্যতম প্রচলিত বায়োপলিমার।
২০১৭ সালে হুর দল প্রথমবারের মতো একটি রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাধারণ কাঠকে শক্তিশালী করে তোলার সাফল্য অর্জন করে, যা ছিল প্রকৃত অগ্রগতি। প্রাথমিকভাবে কাঠকে জল ও বিশেষ রাসায়নিক দ্রবণে সিদ্ধ করা হয়, পরে হট প্রেসিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটিকে উচ্চচাপে সংকুচিত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় কাঠের কোষীয় ঘনত্ব বেড়ে যায়, ফলে এটি আরও শক্ত ও টেকসই হয়ে ওঠে। নেচার জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, এই নতুন কাঠের শক্তি-ওজন অনুপাত অনেক ধাতব সংকর ও কাঠামোর তুলনায়ও বেশি।
আরও পড়ুন: ড্রোন বাহিনী যার-যুদ্ধ জয় তার, কোন দেশগুলি এগিয়ে, ভারতের স্থান কোথায়
বছরের পর বছর গবেষণার মাধ্যমে হু প্রক্রিয়াটি উন্নত করেন এবং ১৪০টিরও বেশি পেটেন্ট দাখিল করেন। এর পরেই সুপারউড বাণিজ্যিকভাবে উন্মুক্ত হয়। ইনভেন্টউডের সুপারউড সাধারণ কাঠের তুলনায় ২০ গুণ বেশি শক্তিশালী এবং ১০ গুণ বেশি আঘাত প্রতিরোধী। কাঠের ছিদ্রময় গঠনকে ঘন ও মজবুত করার ফলে এটি ডেন্ট বা চাপজনিত ক্ষতির বিরুদ্ধে অত্যন্ত প্রতিরোধী। তাছাড়া এটি প্রাকৃতিকভাবে ছত্রাক ও পোকামাকড় প্রতিরোধী, এবং অগ্নি-প্রতিরোধ মানেও উচ্চ রেটিং অর্জন করেছে।
কোম্পানির মুখপাত্র লাউ জানান, ভবিষ্যতে নির্মাণশিল্পে এই কাঠ ব্যবহার করলে ভবনগুলো আধুনিক সমাধানের তুলনায় প্রায় চারগুণ হালকা হতে পারে। এতে ভিত্তি কাঠামোর চাপ কমবে, ভূমিকম্প প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে এবং নির্মাণের গতি বৃদ্ধি পাবে। যদিও সুপারউড বর্তমানে সাধারণ কাঠের তুলনায় দামি এবং উৎপাদনে কিছুটা বেশি কার্বন নিঃসরণ ঘটে, তবে লাউ-এর মতে, “যদি এটি স্টিলের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে ইস্পাত উৎপাদন থেকে নির্গত কার্বন প্রায় ৯০% পর্যন্ত কমে যাবে।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের লক্ষ্য কাঠের চেয়ে সস্তা হওয়া নয়, বরং উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে স্টিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা।”
এর আগে বিভিন্ন ধরনের ইঞ্জিনিয়ারড উড তৈরি হয়েছে, তবে এদের দাবি, সেগুলো মূলত কাঠের ভগ্নাংশ ও আঠা মিশিয়ে তৈরি, কিন্তু সুপারউড হল আণবিক স্তরে পরিবর্তিত প্রকৃত কাঠ।
বর্তমানে কাঠ আবারও নির্মাণশিল্পে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে কাঠের তৈরি আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণ শুরু হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলওয়াকি শহরে ইতিমধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু কাঠের ভবন তৈরি হয়েছে, যার উচ্চতা প্রায় ৮৩ মিটার, এবং ভবিষ্যতে আরও উঁচু কাঠের ভবনের পরিকল্পনা রয়েছে।
যদিও কংক্রিট এখনও পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত নির্মাণ উপাদান, এর উৎপাদনই বিশ্বব্যাপী মোট কার্বন নিঃসরণের প্রায় ৭% এর জন্য দায়ী। তাই সুপারউড-এর মতো শক্তিশালী ও পরিবেশবান্ধব কাঠের সমাধান স্থপতিদের জন্য নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করছে। বৃহত্তর কাঠামো, টেকসই ফ্যাসাড, এবং স্টিল নির্ভরতা কমানোর মাধ্যমে নির্মাণের নতুন যুগের সূচনা করতে যাচ্ছে।
