গোপাল সাহা: বিধানসভা নির্বাচনের কাউন্টডাউন শুরু হতেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির আগুনে ফের ঘি পড়েছে। দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মতো বাংলাতেও শুরু হয়েছে বিশেষ নিবিড় পুনর্বিবেচনা বা SIR (Special Intensive Revision) প্রক্রিয়া৷ ভোটার তালিকা সংশোধনের এক বিশেষ উদ্যোগ, যা নিয়ে ইতিমধ্যেই শাসক তৃণমূল কংগ্রেস ও বিরোধী বিজেপির মধ্যে শুরু হয়েছে প্রবল রাজনৈতিক তরজা।
তবে এবার বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এসেছে এক বিস্ময়কর দাবি। এসআইআর শুরুর আগেই বঙ্গ বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বরা ঘোষণা করে বসেন- পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রায় এক কোটির বেশি ভোটার বাদ পড়বে। আর তাতেই রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন, “এসআইআর শুরু হওয়ার আগেই কীভাবে এমন ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ সম্ভব?” তৃণমূল নেতাদের কটাক্ষ, “বিজেপি রাজনীতি ছেড়ে এবার জ্যোতিষ চর্চায় নেমেছে!”
জাতীয় নির্বাচন কমিশন বেশ কয়েক মাস আগেই ঘোষণা করেছিল, ভোটার তালিকা যাচাই ও সংশোধন করার জন্য দেশজুড়ে শুরু হবে বিশেষ এসআইআর প্রক্রিয়া। উদ্দেশ্য ছিল- ভুল নাম সংশোধন, মৃত ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া, ও নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্তি। কিন্তু ঘোষণার পর থেকেই জাতীয় স্তরে বিরোধী দলগুলির অভিযোগ- এই প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করে ‘ঘুর পথে এনআরসি করানোর’ চেষ্টা চলছে। মূলত বিহারে SIR প্রক্রিয়া কার্যকর করা এবং কয়েক লক্ষ ভোটারদের নাম তালিকা থেকে বাদ যাওয়া নিয়ে বঙ্গ রাজনীতিতে উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে ওঠে এবং স্বর চরে সপ্তমে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একুশে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে ভাষণে সাফ জানিয়েছিলেন, “সংবিধান মেনে এসআইআর করতে আপত্তি নেই, কিন্তু ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে যদি বাংলায় এনআরসি চাপানো হয়, সেটা কোনওভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।” এই বক্তব্যের পর থেকেই কার্যত জ্বলে ওঠে রাজ্য রাজনীতি।
অন্যদিকে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখেও মন্তব্য করতে শোনা যায়, এস আই আর করতে এলে তাদেরকে বেঁধে রাখতে এবং তাদের জন্মের শংসাপত্র নিয়ে আসলে তবে ছাড়তে। বঙ্গ রাজনীতিতে সুর চলেছে সপ্তমে।
এসআইআর আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার আগেই বঙ্গ বিজেপির শীর্ষ নেতারা বিশেষত শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদার সহ একাধিক শীর্ষ নেতৃত্ব দাবি করেন যে “প্রায় এক কোটিরও বেশি ভুয়ো ভোটার বাদ যাবে পশ্চিমবঙ্গের তালিকা থেকে।” এই মন্তব্য ঘিরেই তোলপাড় রাজ্য। অন্যান্য বিরোধীদের মতে, “এসআইআর শুরু হওয়ার আগেই যদি বিজেপি জানে কত ভোট বাদ পড়বে, তবে কি পুরো প্রক্রিয়াই তাদের হাতের মুঠোয়?”
তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেস - তিন দলই একসুরে অভিযোগ তুলেছে, “কেন্দ্র সরকার ও বিজেপি মিলে নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে ভোটার তালিকা সাজাচ্ছে নিজেদের সুবিধেমতো।”
এসআইআর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই রাজ্যের নানা প্রান্তে দেখা দিয়েছে অদ্ভুত এক আতঙ্কের পরিবেশ।
কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া ও উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে বহু পরিবার তাদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। নিউটাউনের উত্তরার মাঠ এলাকা থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, “কয়েকটি পরিবার, যারা বাংলাদেশ থেকে এসে এখানে থাকত, তারা এসআইআর শুরু হওয়ার খবর শুনেই এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে।”
অন্যদিকে আজ উত্তরবঙ্গ এবং পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলীতে ঝোপঝাড়ে ও রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে ভোটার কার্ড ও আধার কার্ড। পুলিশ সেগুলো উদ্ধার করে তদন্ত শুরু করেছে। প্রাথমিক অনুমান, এদের অনেকেই আতঙ্কে নথিপত্র ফেলে পালিয়েছে, তবে কার্ডগুলো আসল না জাল, তা যাচাই করছে প্রশাসন।
রাজ্যের নাগরিক সমাজের একাংশ বলছে- বিজেপি যে দাবি করছে, “বাংলায় বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা ও অবৈধ মুসলিম ভোটার রয়েছে” তা তথ্যভিত্তিক নয়। বরং সাম্প্রতিক বাংলাদেশে অস্থিরতার জেরে অনেক হিন্দু পরিবার সীমান্ত পেরিয়ে বাংলায় আশ্রয় নিয়েছে। এমনটাই দেখা গিয়েছে পুলিশের তথ্যের ভিত্তিতে। তাহলে বিজেপির ‘ভোটার বাদ’ ভবিষ্যদ্বাণী আসলে কোন সমীকরণে দাঁড়িয়ে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, “২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির অতি আত্মবিশ্বাসই তাদের ভরাডুবির কারণ হয়েছিল। এবারের এসআইআর নিয়ে তাদের ‘এক কোটি ভোট বাদ’ তত্ত্ব সেই পুরোনো জ্যোতিষীয় ভ্রান্তির পুনরাবৃত্তি।”
এই বিষয়ে বরিষ্ঠ সাংবাদিক তথা রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সুমন ভট্টাচার্য বলেন, "দেখুন, যে কথা পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতারা বলছেন, তা তাঁরা কিসের ভিত্তিতে বলছেন এবং কেন বলছেন, বোঝা মুশকিল। এটা সম্পূর্ণই হোয়াটস আপ ইউনিভার্সিটির তথ্য বলে মনে হয়। ভোটার বা ভোটার তালিকা নিয়ে বলার এক্তিয়ার নির্বাচন কমিশনের। কোন ভোটারের নাম বাদ যাওয়া উচিত বা কেন উচিত, তা নির্বাচন কমিশন ঠিক করবে। এটা নিজে বিজেপির নেতারা কেন বলবে?"
তিনি আরও বলেন, "২০০২ সালে স্পেশাল ইন্টেন্সিভ রিভিশন এর সময এই বঙ্গের ভোটার ছিল ৪ কোটি ৪৩ লক্ষের কিছু বেশি। তারপরে আর দেশে জনগণনা হযনি। তাহলে কিসের ভিত্তিতে বিজেপি নেতারা এক কোটি মানুষের নাম বাদ যাবে বলছেন ? এস আই আর পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির জন্য ভুল রণকৌশল। এতে বিজেপির হিন্দু ভোটব্যাঙ্কে ফাটল ধরবে।"
তৃণমূল মুখপাত্রদের ভাষায় - “সংবিধানের আওতায় এসআইআর প্রক্রিয়া চলুক, আমাদের কোনও আপত্তি নেই।কিন্তু SIR এর নামে ঘুর পথে এনআরসি করার রাজনীতি বাংলায় হতে দেব না।”
তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র অনির্বাণ ব্যানার্জিকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিজেপির এক কোটি ভোটার বাদ যাবে ভবিষ্যৎবাণী নিয়ে কটাক্ষ করে বলেন, "বঙ্গ বিজেপির বোঝা উচিত দিল্লির কথায় না নেচে সঠিক জিনিসটা বোঝা। কারণ এস আই আর হলে বিজেপিরই বিপদ, অধিকাংশই বাদ যাবে বিজেপি ভোটার অর্থাৎ হিন্দু ভোটার। মুসলিম ভোটার বা রোহিঙ্গা ভোটার বাদ যাওয়া নিয়ে তত্ত্ব বঙ্গ বিজেপির লাফালাফি কোনও কাজেই আসবে না।" তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে আরও বলেন, "এখনও সময় আছে বঙ্গ বিজেপি যদি বুঝতে পারে তাহলে তাদেরই ভালো হবে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বরা বাংলায় এর আগেও ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেছেন এবং ২০০ আসন পাবে বা আরও অনেক তত্ব খাঁড়া করেছেন। তৃণমূলের ভাঙ্গন ধরার কথা বলেছেন। এছাড়াও একাধিক ভবিষ্যদ্বাণী। কিন্তু কোনওটাই ধোপে টেকেনি। এবারেও এক কোটির বেশি নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাওয়ার যে ভবিষ্যৎবাণী সেটাও কোনও কাজে লাগবে না। বরং বিজেপির ভোটব্যাঙ্কেই আঘাত পড়বে। উল্টে এই এসআইআর প্রক্রিয়ায় বঙ্গ বিজেপি মুখ থুবড়ে পড়বে।"
তৃণমূলের পাশাপাশি সিপিআই(এম) ও কংগ্রেসও একই বার্তা দিয়েছে- “ভোটার তালিকা সংশোধন হোক নিরপেক্ষভাবে, বিজেপির নির্দেশে নয়।”
এই বিষয়ে সিপিএম এ রাজ্যসম্পাদক মোঃ সেলিম ও সুজন চক্রবর্তী বলেন, "বাংলায় বিজেপি কে এনেছে তৃণমূল কংগ্রেস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখন নাটক করে রাজনীতি করছেন। সিপিএম কোনওদিন প্রশ্রয় দেয়নি বিজেপিকে, তৃণমূল প্রশ্রয় দিয়েছে এবং বাংলায় সুযোগ করে দিয়েছে। এখন SIR নিয়ে লাফালাফি করে নাটক করছে তৃণমূল। আর বিজেপি বরাবরই নোংরা রাজনীতি করে। এবারও SIR নিয়ে তাই করছে। জাতীয় নির্বাচন কমিশনকে ঘুর পথে ব্যবহার করছে এস আই আর করার নামে।"
সর্বোপরি বাংলা রাজনীতিতে এখন একটাই প্রশ্ন, এসআইআর কি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, না কি নতুন রাজনৈতিক অস্ত্র? আর বঙ্গ বিজেপির এই ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ কি সত্যিই তথ্যনির্ভর, না কি নিছকই জ্যোতিষ চর্চার ফল?
যেভাবেই হোক, এসআইআরকে ঘিরে বাংলার রাজনৈতিক আবহ ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে। ভোটার তালিকা সংশোধনের প্রক্রিয়া এবার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। আর রাজ্যের মানুষ তাকিয়ে, “ভোটার তালিকা নয়, ভোটাধিকারই এবার পরীক্ষার মুখে।”
