আজকাল ওয়েবডেস্ক: দীর্ঘ অনিশ্চয়তা, ভয় ও দুশ্চিন্তার পর অবশেষে স্বস্তির হাওয়া বইছে কোচবিহারের সীমান্তবর্তীর ছিটমহল এলাকাগুলিতে। বহু বছর ধরে 'নাগরিকত্ব' নিয়ে সংশয়ে থাকা মানুষজন এখন নির্ভয়ে 'এনুমারেশন' ফর্ম হাতে নিচ্ছেন।

কারণ, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন স্পষ্ট করে জানিয়েছে ছিটমহল অঞ্চলে চলা স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন-এর ভিত্তিবর্ষ হবে ২০১৫ সাল, ২০০২ নয়। অর্থাৎ, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের ঐতিহাসিক চুক্তি কার্যকর হওয়ার সালকেই নাগরিকত্বের মূল বছর হিসেবে ধরা হচ্ছে।

২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের উদ্যোগে ছিটমহল বিনিময়ের চুক্তি কার্যকর হয়। সেই সময়ই শুরু হয়েছিল জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনপিআর-এর কাজ।

নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী, এই এনপিআর-এর তথ্যই হবে বর্তমান এসআইআরের প্রধান ভিত্তি। ফলে যাঁরা এতদিন নাগরিকত্ব হারানোর আশঙ্কায় ফর্ম নিতে ভয় পাচ্ছিলেন, তাঁরাও এখন নিশ্চিন্তে অংশ নিচ্ছেন এই গণনার প্রক্রিয়ায়।

কোচবিহার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যেই ছিটমহল এলাকার হাজারও মানুষ এনুমারেশন ফর্ম পূরণ করেছেন। প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, প্রাক্তন বাংলাদেশি ছিটমহল থেকে ১৫,৮৫৬ জন এবং প্রাক্তন ভারতীয় ছিটমহল থেকে ৯২১ জন নাগরিকের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এই তালিকায়।

এছাড়া, এক দশক আগে এনপিআর তালিকা থেকে বাদ পড়া ১,১৫৫ জন বাসিন্দার নামও নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। এদের মধ্যে বহু মহিলা আছেন। যাঁরা বিয়ের পর অন্য গ্রামে গিয়েছিলেন এবং সেই সময় নাগরিকপঞ্জিতে নাম ওঠেনি।

সবচেয়ে নজরকাড়া পরিবর্তন ঘটেছে দিনহাটা-২ ব্লকের নাজিরহাট-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত মধ্য মশালডাঙা এলাকায়, যা একসময় ছিল বাংলাদেশি ছিটমহল। এখানকার ২৯ নম্বর বুথে প্রায় ১,৪০০ জন ভোটার রয়েছেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, আগে যখন ফর্মে ২০০২ সালের তথ্য চাওয়া হয়েছিল, তখন তাঁরা ভারতীয় নাগরিকই ছিলেন না তাই সঠিক তথ্য দেওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু এখন ২০১৫ সালকে ভিত্তিবর্ষ হিসেবে ধরায় তাঁরা সহজেই নিজেদের নাগরিক পরিচয় দিতে পারছেন।

কয়েকদিন আগেই কোচবিহারে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধি দল আসে। সেই বৈঠকের পর রাজ্যের মুখ্য নির্বাচন আধিকারিক মনোজ আগরওয়াল ঘোষণা করেন, “ছিটমহলবাসীদের এসআইআর-এর ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হবে না। সব বিষয় প্রশাসনিকভাবে মিটে গিয়েছে।”

এবিষয়ে জেলা প্রশাসনের এক আধিকারিক  জানান, “আমাদের কাছে প্রত্যেক পরিবারের নাগরিকত্ব ও পরিচয় সংক্রান্ত পূর্ণ তথ্য রয়েছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই এখন ফর্ম পূরণ হচ্ছে।”

প্রশাসনিক ও নির্বাচন কমিশনের এই পদক্ষেপে সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা গিয়েছে স্বস্তি ও আস্থার পরিবেশ। কোচবিহারের মধ্য মশালডাঙা, দহলা খাগরাবাড়ি, বালাপাড়া-সহ একাধিক ছিটমহল এলাকায় এখন ব্যস্ততা শুধু ফর্ম পূরণ নিয়ে।

মানুষ বলছেন “এবার নিশ্চিন্তে ভোটার তালিকায় নাম উঠবে, কোনও ভয় নেই।” দীর্ঘ অপেক্ষার পর এই পদক্ষেপ ছিটমহলবাসীদের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

২০১৫ সালের ঐতিহাসিক চুক্তি শুধু সীমান্ত বদলায়নি, বদলে দিয়েছে হাজারও মানুষের পরিচয়ের ইতিহাসও। আর আজ, সেই পরিচয়ের বৈধ স্বীকৃতি মিলছে এনুমারেশন ফর্মের কলমে। ফলে ভয় নয়, ফিরেছে বিশ্বাস।