গোপাল সাহা: 'এবার আমার কী হবে? এতটা উদয়স্থ পরিশ্রম করে বিশেষ নিবিড় সংশোধন (SIR) প্রক্রিয়ায় কাজ করলাম, তারপরেও আমাকে শেষ মুহূর্তে বিএলও আধিকারিকদের অফিসিয়াল গ্রুপ থেকে বার করে দিলেন এখানকার স্থানীয় এসডিও পদমর্যাদার ইআরও আধিকারিক উৎপল ঘোষ। আমাকে বিএলও পদে রাখবেন না বলেছেন।' একরাশ ক্ষোভ প্রকাশ করে, আতঙ্কিত হয়ে নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়ে জানালেন পুরুলিয়ার শিক্ষিকা তথা ১৯৬ নম্বরের বিএলও সোনালি ব্যানার্জি।
উল্লেখ্য, গত ৪ নভেম্বর বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়া শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গ সহ ১২টি রাজ্যে, জাতীয় নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী। আর তারপর থেকেই পশ্চিমবঙ্গ সহ একাধিক রাজ্যে এই প্রক্রিয়ার কারণে মানসিক চাপ ও পরিশ্রমের কারণে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে বেশ কয়েকজন বিএলও আধিকারিকের। এমনটাই অভিযোগ তুলেছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। অবশেষে শুরু হয় এক বিরাট আকারের আন্দোলন। নির্বাচন কমিশনের অধীনে কর্মরত 'বিএলও'দের ওপরে অমানুষিক চাপ সৃষ্টি করার অভিযোগের ভিত্তিতে। সংঘটিত হয় বুথ লেবেল অফিসারদের (BLO) 'বিএলও অধিকার রক্ষা কমিটি', যারা রীতিমতো আন্দোলনে বসে পড়েন রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক দপ্তরের সামনে।
একাধিকবার সিইও দপ্তর অভিযান পর্যন্ত হয় এবং দফায় দফায় চলে বিক্ষোভ সমাবেশ ও প্রতিবাদ মিছিল। সিইও দপ্তর অভিযানের পাশাপাশি সিইও অফিস ঘেরাও চলে ৩০ ঘণ্টা ধরে। তথাপি অভিযোগ, সিইও আধিকারিক মনোজ আগরওয়ালের দেখা পাওয়া যায়নি। যদিও এই বিক্ষোভের পর BLO অধিকার রক্ষা কমিটির প্রতিনিধিরা দপ্তরে গিয়ে তাঁদের ডেপুটেশনের মাধ্যমে লিখিত অভিযোগ জমা দেন এবং পাশাপাশি তাঁদের একাধিক অভিযোগ তুলে ধরেন নির্বাচন কমিশনের দপ্তরে। তাঁদের অভিযোগে নির্বাচন কমিশন কোনওরকম কর্ণপাত করেনি। তাঁদের আরোও অভিযোগ, BLO পদে নিযুক্ত করার পূর্বে তাঁদেরকে সঠিকভাবে ট্রেনিং পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। এছাড়াও রয়েছে ডিজিটাইজেশনের ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সমস্যা। ফলে একাধিক খামতি থাকার কারণে তাঁরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং বহু বিএলও আধিকারিকের কখনও আত্মঘাতী, কখনও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে।
যদিও পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশন অফিশিয়ালি ১০জন BLO আধিকারিকদের মৃত্যু হয়েছে বলে সম্মতি প্রকাশ করে। অন্যদিকে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের দাবি সংখ্যাটা ৩০-এরও বেশি। ফলে এই নিয়েও কার্যত চলে বাদানুবাদ। পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, এই ১০জন বিএলও আধিকারিক, যাঁদের কর্মরত অবস্থায় মৃত্যু ঘটেছে, তাঁদেরকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কিন্তু আত্মঘাতী হয়ে কারও মৃত্যু হলে, সে বিষয়ে কোনও দায় বা ক্ষতিপূরণ দেবে না নির্বাচন কমিশন, বলেই সূত্রে খবর।
অবশেষে এদিন ১৬ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত সময় অনুযায়ী খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয় এবং যেখানে বাদ যায় ৫৮ লক্ষ ২০ হাজার জন ব্যক্তির নাম। মূলত এই বাদ যাওয়া নাম (ASDD) - অনুপস্থিত, স্থানান্তরিত, মৃত এবং ডুবলিকেট এই চারটি ডিভিশনের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের নাম বাদ যায় খসড়া তালিকা থেকে। পাশাপাশি 'বিএলও অধিকার রক্ষা কমিটি'র আন্দোলন ও বিক্ষোভ চলতে থাকে সমান্তরাল ভাবে। তাদের বক্তব্য নির্বাচন কমিশন তাদের দাবি যতক্ষণ মানবে না, ততক্ষণ তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, এর মধ্যে ঘটে যায় আরও এক বিতর্কিত এবং অমানবিক ঘটনা। অভিযোগ পুরুলিয়া নিবাসী স্কুল শিক্ষিকা তথা ১৯৬ নম্বর বুথের বিএলও আধিকারিক সোনালি ব্যানার্জিকে ইচ্ছাকৃতভাবে সেখানকার ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসার (ERO - এসডিও পদমর্যাদার) আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে BLO আধিকারিকদের অফিসিয়াল গ্রুপ থেকে বহিষ্কার করে দেন। এবং একইসঙ্গে তাঁকে হুমকি দেওয়া হয় বিএলও আধিকারিক পদ থেকে পদচ্যুত করা হবে। এমনটাই অভিযোগ তোলেন বিএলও সোনালি ব্যানার্জি।
আরও অভিযোগ, পুরুলিয়ার এই ERO আধিকারিক উৎপল ঘোষ বিজেপি দ্বারা প্রভাবিত এবং পাশাপাশি বিজেপি সমর্থক। সেই কারণেই নাকি বিএলও আধিকারিকদের আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে মানসিকভাবে চাপ দিচ্ছেন ১৯৬ নম্বর বুথের বিএলও আধিকারিক সোনালি ব্যানার্জিকে।
বিএলও আধিকারিক তথা শিক্ষিকা সোনালি ব্যানার্জি আজকাল ডট ইনের মুখোমুখি হয়ে জানিয়েছেন, পুরুলিয়ার এসডিও পদমর্যাদার আধিকারিক তথা ইআরও উৎপল ঘোষ তাঁর সঙ্গে কোনওরকম কোনও কথা বলতেই ইচ্ছুক নন। তিনি নাকি সোনালি ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলতেই ভয় পাচ্ছেন। পাশাপাশি একাধিক অজুহাত দেখিয়ে অফিসিয়াল গ্রুপ থেকে বহিষ্কার করে এবং বিএলও আধিকারিকের পথ থেকেও জোর করে অব্যাহতি দেওয়ার চেষ্টা করছেন। যদিও এই বিষয়ে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক দপ্তরের আধিকারিক জানিয়েছেন, এই বিষয়ে সোনালি ব্যানার্জীর কোনওরকম ভয় নেই। কেউ তাঁকে এই পদ থেকে অন্যায়ভাবে সরাতে পারবেন না।
বিএলও সোনালি ব্যানার্জি আরও বলেন, 'আমি সত্যি আতঙ্কিত, যেভাবে আমাকে বিনা নোটিশে নির্বাচন কমিশনের অফিসিয়াল গ্রুপ থেকে বহিষ্কার করেছেন তাতে যেকোনও সময় ERO তাঁর ক্ষমতা বলে যদি পদচ্যুত করিয়ে দেন, তাহলে এতদিনের আমার চরম পরিশ্রম যেমন বৃথা হবে, তেমনি নির্বাচন কমিশনের কাছে আমি অপরাধী হয়ে যাব। তাই আমি সত্যিই এই ঘটনায় যথেষ্ট আতঙ্কিত ও ভীত সন্ত্রস্ত।' তবে তিনি রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক দপ্তরের কাছে এই বিষয়ে অভিযোগ ও ন্যায় বিচার দাবি করলে সম্পূর্ণভাবে সহযোগিতা ও নির্ভয়ে কাজ করার আশ্বাস পেয়েছেন।
এখন প্রশ্ন উঠছে, রাজ্যে (SIR) বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়ার প্রথম পর্যায় শেষ হতে না হতেই এ ধরনের অভিযোগ যদি সত্যি হয় এবং অমানবিক চিত্র যদি সামনে আসে ERO আধিকারিকের, তবে সত্যিই বিএলও আধিকারিকদের স্বস্তিতে কাজ করা এবং সুষ্ঠুভাবে আগামীতে কাজ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট মানসিক চাপ ও বড় বিপদের বার্তা বহন করছে। যা নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়ায় এ ধরনের ঘটনা আরও জটিল করে তুলবে। যদি বিএলও আধিকারিকদের সঙ্গে তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে বিরুদ্ধাচারণ করেন, তবে মানসিক চাপে নির্ভুল তথ্য পরিবেশন করে সঠিকভাবে কাজ করা সত্যিই সমস্যার। জনগণকে সঠিকভাবে পরিষেবা দিতে পরবর্তীতে শুনানি পর্বে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা নিয়ে বিরাট বড় প্রশ্ন তুলে ধরে!
