মনিরুল হক, কোচবিহার: কোচবিহারের অন্যতম বৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব হল রাস উৎসব। বছরের এই সময়ে পুরো কোচবিহার শহর মেতে ওঠে আনন্দ ও ভক্তির আবহে। রাজবাড়ি সংলগ্ন মদনমোহন মন্দির প্রাঙ্গণেই বসানো হয় এই উৎসবের প্রাণ ‘রাসচক্র’। সেই ঐতিহ্য মেনে প্রতিবছর জেলার জেলাশাসক নিজ হাতে রাসচক্র ঘুরিয়ে উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এই রাসচক্র ঘোরানোই কোচবিহারের জনগণের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ। উৎসবের দিনগুলোতে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমান মদনমোহন মন্দিরে। চক্র স্পর্শ করে বা ঘুরিয়ে তাঁরা নিজেদের ভক্তি প্রকাশ করেন। সম্প্রীতির প্রতীক এই উৎসব আজও কোচবিহারের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবধারাকে তুলে ধরে।
উল্লেখ্য, এই রাসচক্র তৈরির দায়িত্ব বহু প্রজন্ম ধরে বহন করে আসছে কোচবিহারের এক মুসলিম পরিবার। রাজ আমল থেকেই এই পরিবার রাসচক্র নির্মাণের কাজ করে আসছে। আগে এই চক্র তৈরি করতেন আলতাপ মিয়াঁ। এখন সেই ঐতিহ্য ধরে রেখে তাঁর ছেলে আমিনুর মিয়াঁ নিজের দক্ষ হাতে তৈরি করছেন এবারের রাসচক্র। আলতাপ মিয়াঁর মতোই, আমিনুরও সম্পূর্ণ নিয়ম–নিষ্ঠা মেনে এই চক্র তৈরির কাজ করেন। লক্ষ্মী পূর্ণিমার পর থেকেই তিনি নিরামিষ ভোজন করে শুরু করেন এই পবিত্র কাজ।
আমিনুরের কথায়, ‘এটা শুধু কাজ নয়, ভক্তির প্রতীক। আমাদের পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই দায়িত্ব পালন করে আসছে। আমি গর্বিত যে সেই ঐতিহ্য আমি বয়ে নিয়ে যেতে পারছি।’
চক্র তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় বাঁশ, কাঠ, কাগজ ও কাপড়। পুরো কাঠামোটিতে সূক্ষ্ম কারুকার্য করা হয়, যা দেখতে আসেন অসংখ্য মানুষ। প্রতিটি ঘূর্ণন, প্রতিটি বাঁকেই ফুটে ওঠে শিল্প ও আস্থার মেলবন্ধন। এই বছর ৫ নভেম্বর রাস পূর্ণিমা, আর তার আগেই জোরকদমে চলছে রাসচক্র তৈরির শেষ পর্যায়ের কাজ। স্থানীয় শিল্পী ও সাহায্যকারীরা দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছেন যাতে নির্দিষ্ট সময়ে চক্র প্রস্তুত হয়।
প্রশাসন থেকে নিরাপত্তা ও দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। রাসমেলা উপলক্ষে কোচবিহারে ইতিমধ্যেই আলো, মেলা, স্টল ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে। রাসচক্র যেমন কোচবিহারের সংস্কৃতি ও ভক্তির প্রতীক, তেমনি আমিনুরের মতো মানুষের হাতে আজও সেই ঐতিহ্য বেঁচে আছে, যা প্রমাণ করে, ধর্ম নয়, ভক্তি ও ঐক্যই কোচবিহারের আসল পরিচয়।
